আমাদের গাড়িদেরও রোগবালাই হয়, কোনোটা সারে, কোনোটা সারে না। বাইরে থেকে দেখতে আমাকে এখনো ঠিকঠাক দেখালেও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বাসার সামনে পড়ে আছি কয়েক সপ্তাহ ধরে। শারিরীক ও মানসিক কষ্টে আগের চেয়ে অনেক বেশি নীল হয়ে গেছি আমি। আমার প্রিয় মালিক যুগলটি যখন আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গ্যারেজের সামনে পার্ক করা নতুন চকচকে লেক্সাসটায় গিয়ে ওঠে, আমি গুনগুনিয়ে গাই, 'আমারই বঁধুয়া আন বাড়ি যায় আমারই আঙ্গিনা দিয়া।' আমার এই আর্তনাদ তাদের কানে যায় কী না জানি না কিন্তু মেয়েটি প্রতিবারই আড়চোখে আমার দিকে তাকায়। তাকেও খানিকটা নীল মনে হয় আমার কাছে।
আমার মালিক পুরুষটির সাথে আমার সম্পর্কের মাঝখানে প্রথম যেদিন এই মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছিলো আমার ঈর্ষা হয়নি মোটেই, বরং ভালো লেগেছিলো। কী আলতোভাবে দরজা খুলে প্যাসেঞ্জার সিটে বসেছিলো মেয়েটি! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলো, 'জীবনে প্রথমবারের মতো প্যাসেঞ্জার সিটে বসলাম, খুব আরাম লাগছে'। একটা মেয়ের এধরনের কথার উত্তরে কী বলতে হয় জানে না পুরুষটি, অর্বাচীনের মতো বলে বসে, 'আমার কিন্তু ড্রাইভিং সিটে বসা নারীকেই বেশি আকর্ষনীয় মনে হয়।' এই বেয়াড়া উত্তরে মেয়েটা দমে যায় না। হেসে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, 'প্যাসেঞ্জার সিটে বসেও ড্রাইভ করা যায় কিন্তু। সময় এলে দেখিয়ে দেব।' পুরুষটা হাসে, তাকে এতো খুশি আগে কখনো দেখি নি আমি।
এর পরের কয়েক বছর ধরে মেয়েটাকে দক্ষতার সাথে ঠিক তাই করতে দেখে এসেছি। পুরুষটা প্রায়ই বলে, 'আমি গাড়ি চালাই, আর তুমি আমাকে চালাও'। আমি এদেরকে নিয়ে হাজার হাজার মাইল ছুটেছি কিন্তু কখনো ক্লান্ত বোধ করি নি। সবসময় মনে হয়েছে একটা চমৎকার জীবন নাটকের বিবেকের চরিত্রটা আমার। আমি তাদের নাটকীয় সব কথোপকথন শুনি আর হাসি। সত্তর মাইল গতিতে আমি ছুটছি, তারা নাটকের ডায়ালগ আউড়িয়ে রিহার্সাল করছে। একটু পরে পরেই পুরুষটা বলছে,
'দেখি একটু কফি দাও।'
'এর পরেই তো সিগারেট চাইবে।'
'তা তো চাইবো ই'।
'সিগারেট কি গাছে ধরে?'
'শুনেছি টোবাকো গাছ থেকেই আসে।'
অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ে লোকটা।
মেয়েটাও খিলখিলিয়ে হাসে। এইসব লং ড্রাইভের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে মেয়েটা। এইসব দীর্ঘ যাত্রাপথে তার বেশি মাখামাখিতে অনুৎসাহিত সঙ্গীটির সাথের একফুট দূরে বসা ঘনিষ্ঠতা তার মতোই উপভোগ করি আমিও। কী চমৎকার করে কথা বলে দু'জনে, কোনো রোমান্স নেই তবু কী রোমান্টিক! তাদের ঝগড়াগুলোও কী মিষ্টি!
প্রায়ই ঘুমে ঢুলে আসে পুরুষটার চোখ। মেয়েটা তখনই ঝগড়া শুরু করে দেয়,
'বাইরে গেলে এতো খাও কেনো? এজন্যই তো ঘুম পায়।'
'বেশি করে না খেলে ভাবী মনে কষ্ট পেতো যে!'
'বাসায় তো এতো খাও না? আমার রান্না ভালো লাগে না বুঝি?'
'তোমারটা যখন ইচ্ছে খেতে পারবো, ভাবীর হাতেরটা এক সুযোগে বেশি করে খেয়ে নিলাম।'
লং ড্রাইভে ছুটছি আমরা তিনজন, মোবাইলে খেলা দেখছে ক্রিকেট-পাগল দম্পতি। খেলা জমে উঠতেই হাইওয়ের পাশে আমাকে থামালো তারা শান্তিতে শেষ ক’টা বল দেখবে বলে। একের পর এক ছক্কা মারছে টাইগাররা। উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠছে মেয়েটি,
'ইশ, এই টাইগারগুলারে পাইলে একটা চুমা দিতাম।'
'ওদেরকে যখন পাচ্ছো না, ওদের ফ্যানদেরকেই চুমা দাও।'
মেয়েটা লোকটার পিঠে কিল বসিয়ে দেয়, মুখে হাসি। এমন রসিক সঙ্গী কার না ভালো লাগে?
তারা আগের মতোই তাদের নতুন কেনা লেক্সাসে করে লং ড্রাইভে যায়। আমি বাসার সামনে স্থবির হয়ে পড়ে থাকি, আমার যে কী ভীষণ কষ্ট লাগে মেয়েটা নিশ্চয়ই জানে। সে প্রায়ই আমার গায়ে হাত বুলায়, পুরুষটাকে বলে, 'গাড়িটার কিছু করো, প্রতিদিন এটাকে রেখে অন্যটায় উঠতে আমার কষ্ট হয়।'
একদিন সে বলছিলো, 'জানো এই গাড়িটার জন্য আমার কেনো এতো মায়া? দীর্ঘ সময় প্ল্যাটফর্মে বসে ছিলাম। কত ট্রেন এলো গেলো, কোনোটাই আমার ছিলো না। শেষ পর্যন্ত ধরেই নিয়েছিলাম আমার ট্রেনটা কোনোদিনই আসবে না। ঠিক তখনই আমাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলো এই নীল গাড়িটা। আমার আদরের নীল গাড়িটা!'
খুব শীগগিরই আমার শেষ ঠিকানা স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়া হবে আমাকে। মেয়েটার পরম স্বস্তির সেই প্যাসেঞ্জার সিটটা উপড়ে ফেলা হবে। আমার ধাতব দেহকে টুকরা টুকরা করে নানান কাজে লাগিয়ে দেয়া হবে। আমি তো মরতেই বসেছি তবু ভাবতে ভালো লাগে ভালোবাসা-মগ্ন দুটো মানুষের সাথে কেটেছে আমার জীবনের শেষ কটা দিন। আমি তাদের প্রথম দ্বিধাপূর্ণ হাত ধরাধরি দেখেছি, প্রথম চুম্বন দেখেছি, তাদের প্রথম নিবিড় আলিঙ্গনের সাক্ষ্মী আমি। আমি তাদেরকে পাহাড়ের কাছে নিয়ে গেছি, সাগরের কাছে নিয়ে গেছি, আমি তাদেরকে জীবনের কাছে নিয়ে গেছি, ঝড়ের ঝাঁপটা তুষার থেকে বুক দিয়ে আগলেছি। আমি চলে যাই, তবু তারা ভালো থাকুক। একটা যন্ত্রের জীবনে এর চেয়ে বেশি পাওয়া আর কী হতে পারে?