নার্স বললো, হাতে স্যালাইন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সুই দিবেন নাকি? নার্স মিটি মিটি হাসে। একটু পর দেখি একটা সুই-এর মতো কি যেন নিয়ে হাজির। সুস্থ মানুষ আমি, কেনো আমার হাতে সুই দিবে? আমি বললাম, এটা ছাড়া কি সম্ভব না? নার্স আবার হাসে। বলে, ভয় পাবেন না, কিছু হবে না। ব্যথা দেবো না। এমনিতে আমি ভীত মানুষ না, কিন্তু আজ সুই দেখে অস্বস্তি লাগছে। গত নয় মাস ধরে নানা কারণে অস্বস্তি শুধু বেড়েছেই, কমে নি।
সারাক্ষণ মনের ভিতর খচ খচ, সব ঠিক আছে তো? কোনো ক্ষতি হলো না তো? যারা ক্ষতি করতে চাইছে, তারা সফল হলো না তো? এই সব নানাবিধ চিন্তা। সকাল বেলা দৌড়ে দৌড়ে অফিসে ঢুকেই হেড ফোন দিয়ে তোকে গান শুনাতাম, এই ভেবে যাতে আমার ব্যস্ততা তোকে ক্লান্ত করে না দেয়। তুই কি দিনশেষে ক্লান্ত হয়ে পড়তি?
ডাক্তার এলো, এসেই বললো, কিছুক্ষনের মধ্যেই আপনাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকাবো। সবাইকে এটা সেটা নির্দেশনা দিয়ে ব্যস্ত করে ফেললো। আমি অপেক্ষায় থাকলাম।
অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে দেখি ডাক্তার একটা না, একাধিক। সবাই তাদের পরিচয় দিলো, বুঝলাম একজন ডাক্তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন আর বাকিরা সহযোগী। যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি বসে আছেন, আর বাকিরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই প্রথম আমি অপারেশন থিয়েটারের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তবু একা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে বাচ্চার বাবারা শিশুর জন্মলগ্নের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তাই জন্মের যন্ত্রণা বোঝার ক্ষমতা তাদের কখনই হয় না। অপারেশন থিয়েটারের উপস্থিত হাসপাতালের লোকজন বাদ দিলে, বাংলাদেশের অন্য সকল শিশু আর শিশুর মায়েদের মতো তোর জন্মলগ্নের সকল যন্ত্রণার একমাত্র সাক্ষী হলাম আমি। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে তোর কান্নার শব্দ, অসম্ভব বিরক্তি আর যন্ত্রণার কান্না মনে হয়েছিলো আমার কাছে -সব শিশুর প্রথম কান্নাই কি এরকম? কান্না শোনার পর খুব বেশিক্ষন আর জেগে থাকতে পারিনি সেদিন -কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভেঙ্গে প্রথম যখন তোকে দেখার সুযোগ হলো বুঝলাম জন্ম দিলেও অন্য অনেকের মতো আমি অলৌকিকভাবে মা হয়ে গেলাম না, কারণ আমি নিজের ভিতরে বিশেষ কোনো মা মা অনুভূতি অনুভব করতে ব্যর্থ হলাম। কিংবা হয়তো কেউ-ই সেভাবে মা হয় না, সবাই-ই হয়তো ধীরে ধীরেই মা হয়ে ওঠে বা কোনো দিনই হতে পারে না। সে যাই হোক, আমি তাকিয়ে রইলাম হলুদ ছোট্ট কাথায় মোড়ানো ফ্যাকাসে এক শিশুর দিকে, আমার পাশে ছোট একটা বেবি কটে শুয়ে কাঁদছে। এক ভিন্ন স্বত্ত্বা, আমার মাঝে বেড়ে ওঠা সম্পূর্ন আলাদা এক মানুষ।
তোর কান্নার শব্দেই ঘুম ভেঙ্গেছিলো বোধ করি। খুব বিরক্তি হলো। ঘুম পাচ্ছিলো আমার, গলা শুকিয়ে এসেছিলো। নার্সকে বললাম, পানি দিতে। কিন্তু কেউ পানি খেতে দিল না। বলল, স্যালাইন চলছে, ডাক্তারের অনুমতি নাই। আমার শরীরের নিচের অংশটা তখনো অবশ হয়ে ছিল ব্যাথায়। আমি আবারো ডাকলাম, প্লিজ আমাকে একটু পানি দিন, আমার খুব গরম লাগছে, একটু ফ্যানটা চালান না প্লিজ? কেউ এগিয়ে আসে না। আমি বললাম, ব্যথা তো কমছে না। একজন নার্স বললো প্যাথেড্রিন দেয়া হয়েছে ব্যথা তো কমার কথা, বুঝলাম প্যাথেড্রিন খুব শক্ত টাইপের কোনো ওষুধ হবে যাতে ব্যথা না কমে উপায় নাই, কিন্তু আমার কমলো না। আমি আবার গোঙ্গানির মতো বললাম, ব্যথা কমে নি, ব্যাথার ওষুধ আমার সহজে ধরে না। আপনারা ডাক্তারকে বলেন, তিনি বুঝবেন।
আমার কাছে তখন ঘড়ি ছিলো না, আন্দাজ করি রাত তখন ২টা কি ৩ টা হবে। একটু পর নার্স এসে আবার ব্যাথার ওষুধ দিয়ে গেলো। আমার ঘুমাতে ইচ্ছা করছে কিন্তু তুই একটু পর পর কেঁদে উঠছিস। তোর কান্না শুনলেই আমার গলা শুকিয়ে আসছে। আমি আবার বললাম, একটু পানি দেন না প্লিজ, গলা শুকিয়ে গেছে।
একজন আয়া বললো, চুপ করেন, দিবে না, বলেই সে একটা প্লাস্টিকের গ্লাসে অল্প একটু পানি নিয়ে এসে বললো, হা করেন, ঢেলে দিচ্ছি। আমি হা করলাম। দুই তিন চা-চামচ পরিমান পানি গলায় পরলো বোধ হয় কিন্তু তৃপ্তি মিটলো না।
তুই আবার কেঁদে উঠলি, নার্স বললো, দুধ খাওয়াতে হবে। বাচ্চার ক্ষুদা লেগেছে। কিন্তু আমি তো উঠে বসতেই পারি না ......। ক্ষুধা আর কান্নায় এভাবেই পার হলো তোর-আমার প্রথম রাত।
ভোরের আলো ফুটতেই আবার তাকালাম তোর মুখের দিকে, বোঝার চেষ্টা করলাম তুই দেখতে কার মতো। বুঝতে পারলাম না। ভালো করে তাকিয়ে বুঝলাম তোর মাথা ভরা চুল কিন্তু ভ্রূ বলতে কিছু নাই। আমি মনে মনে ভাবি, সে আবার কি, মানুষের বাচ্চা কিন্তু ভ্রূ নাই। এমন হলো কেমন করে? আমি তো আর জানি না, এতো ছোট বাচ্চার ভ্রূ নাই-ই থাকতে পারে! তোকে কোলে নেবার আগ্রহ হলো কিন্তু তলপেটের দগদগে ক্ষত আর ব্যাথা আমাকে অসহযোগিতা করবে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডাক্তার বলল, ব্যথা থাকবে আরো কিছুদিন।
শারিরিক ব্যথা, ক্ষত শুকাবার সাথে সাথে সেরে উঠেছিলো সপ্তাহ খানেকের মাঝেই। কিন্তু নয় মাসের শারিরিক পরিবর্তন আর পারিপার্শ্বিক অনাকাঙ্খিত অস্থিরতা, মানসিক দৃঢ়তাকে দুর্বল করে দিয়েছিলো অল্প অল্প করে। আর সেটা বুঝলাম যখন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, এমনকি দৈনিক খবরেও তোকে কল্পনা করতে শুরু করলাম। কোনো না কোনো চরিত্রে তোকে খুজে পেতে লাগলাম, সাথে নিজেকেও। গল্পগুলোর সাথে সাথে কল্পনায় কখনো তোর বয়স বেড়ে কুড়ি, আবার কখনো সদ্যোজাত শিশু। মানসিক অস্বস্তি আরো বাড়তে থাকলো দিনে দিনে, ধীরে ধীরে। কখনো নিজেকে খুজে পেতে শুরু করলাম সেই কুড়ি বছর বয়সী ধর্ষিতা যুবতীর বৃদ্ধা মা এর ভূমিকায় আবার কখনো সদ্যোজাত এসিড-দগ্ধ শিশুর অসহায় তরুণী মায়ের রূপে। হঠাৎ করেই যেন এই জনবহুল দেশে আমি অসহায় আর একা হয়ে গেলাম। প্রতিটা গল্পের মাঝে তুই যেমন মরে যেতি প্রতিদিন, আমিও। বারবার মরে যেতাম, আবার বেঁচে উঠতাম। নতুন জীবন পেয়েই তোর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতাম, মনে মনে বলতাম, “ক্ষমা করে দিস আমায় মা। ক্ষমা করে দিস, যদি পারিস। অপার্থিব জগত থেকে তোকে এই নরকে ডেকে এনেছি বলে। এ এমন এক নরক যেখান থেকে বোধ করি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও পালিয়ে বেঁচেছেন।“
আমি অবুঝ ছিলাম, তাই নিজেকে পূর্ণ করতে সমাজ এবং প্রকৃতির নিয়মে তোকে গর্ভে ধরেছিলাম, ধৈর্য্য ধরে সকল অশান্তি মেনে চুপ করে ছিলাম দীর্ঘ নয় মাস। শুধু এই ভেবে যে ফাগুনের হাওয়া, বৈশাখের উত্তাপ, বর্ষার রিনিঝিনি তোর হৃদয় স্পর্শ করবে একদিন। তুই আমারই মতো এই বাংলার মুখ দেখে মুগ্ধ হবি। কোনো একদিন ঢাকার রাস্তায় আমার সাথে হাত ধরে হেটে যেতে যেতে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠবি “ও আমার বাংলাদেশ, প্রিয় জন্মভূমি”। কিন্তু তেমনটা হলো কই? অন্ধকারে ঢেকে গেলো প্রত্যাশার সকল আলো। সমাজের কুৎসিত কালো অভিশাপগুলো শুধু সম্পূর্না হয়ে জন্মাবার দায়ে তোর-আমার গলা চেপে ধরলো। আমাদের কথা বলতে দিবে না বলে হই-হই, রই-রই রব উঠলো, ঐ রাস্তায় হাঁটতে দিবে না বলে, ঐ খোলা আকাশের নিচে হাঁটা বারণ হলো। আমি বুঝলাম, আমার ভুল হয়েছে, আমি বুঝলাম, এ শুধু ভুল নয়, আমার পাপ হয়েছে। শয়তানের দেশে মানব সন্তান জন্ম দেবার পাপ। তোকে এই অভিশপ্ত মানব জন্মে টেনে আনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা ছাড়া আজ আমার আর কিছুই করার নেই। যে বিরক্তির কান্না নিয়ে তুই জন্মেছিলি হয়তো সেই বিরক্তি নিয়ে-ই বাকি জীবনটা পাড়ি দিবি কিন্তু আমি অপরাগ, তোকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবার কোনো পথ আমার জানা নাই। তাই ক্ষমা প্রার্থনাই আমার একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত।