আলহাজ্ব মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ

অনলাইন একটিভিস্ট।

আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি, তুমি কি নিতে প্রস্তুত ভগিনী?

হে নারী, 
তোমার শরীরের মালিক তুমি, আমরা নই। নারীই যে তার শরীরের মালিক একথা বাংলাদেশে প্রথম বলেছেন তসলিমা নাসরিন। সহস্র বছর ধরে যারা বলেছিলো, “আমরা নারীর শরীরের মালিক”, তারা ভড়কে গেলো। তারা তাদের কায়েমি স্বার্থের আকাশে ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা দেখতে পেলো৷ আমরা যারা পুরুষ হয়ে জন্মেছি তাদের শিক্ষাটা ছিলো অন্যরকম। আমাদের বোনদের শিক্ষা আর আমাদের শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য ছিলো।

 
আমরা শৈশব হতেই শিখেছিলাম -আমরা হচ্ছি যোদ্ধা, আমরা হচ্ছি বাঘ, আমরা হচ্ছি ভূস্বামী। আমাদেরকে শেখানো হচ্ছিলো -পুরুষ জোরে কথা বললে সে বাদশাহ, আর নারী বললে সে বেশ্যা। আমাদেরকে শেখানো হচ্ছিলো -নারী হচ্ছে শস্যক্ষেত্র, নারীতেই সব অমঙ্গল, নারীরা নরকে যাবে বেশি। আমরা শিখেছিলাম -অবাধ্য স্ত্রীকে পিটিয়ে বাধ্য করতে হয়, এক বউ কথা না শুনলে তাকে শায়েস্তা করতে অন্য বউ ঘরে তুলতে হয়। 

আমরা শিখেছিলাম -আমাদের বিয়ে করা বউ দিনে আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর সেবা প্রদান এবং রাতে আমার সেবা প্রদান করতে বাধ্য। আমরা শিখেছিলাম -নারী হচ্ছে হাতবদলের ‘বস্তু’, আজ বাপের হাতে, কাল ‘স্বামীর’ হাতে। আমরা শিখেছিলাম -আমাদের নাম স্বামী, এবং তাদের নাম স্ত্রী। আমরা শিখেছিলাম -আমাদের বহুগামিতা আমাদেরকে ‘বেশ্য’ না বানালেও তাদের বহুগামিতা তাদেরকে বেশ্যা বানায়। আমরা শিখেছিলাম -আমরা প্রস্রাব চাপলে যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়তে পারি, কিন্তু নারী তা পারে না।
আমরা শিখেছিলাম -আমাদের পুরুষাঙ্গে চারজন নারীর সমান ক্ষমতা আছে, কিন্তু নারীর তা নেই।

হাজার বছরের কালচারের নামে, ধর্মের নামে এই বৈষম্য আমরা মনেপ্রাণে মেনেই নিয়েছিলাম, কারণ আমরা জানতাম না। আমরা ভিন্নভাবে বুঝতে পারতাম না। আমরা মেঘের গর্জন শুনে প্রশ্ন করতে শিখি নি, কেনো হচ্ছে গর্জন? আমরা পাখির ডাক শুনে প্রশ্ন করতে শিখি নি, কেনো ডাকছে এত সুমধুর সুরে? আমরা ফুলের ঘ্রাণ শুঁকে প্রশ্ন করতে শিখি নি, কেনো ফুল বিলাচ্ছে এত আকুল করা ঘ্রাণ?

আমরা শেকল ভাঙার কথা ভাবতেও পারি নি, কখনও পারি নি।

শেকলভাঙ্গার গানটা প্রথম শুনেছি তসলিমার মুখেই। এই শেকলভাঙ্গার গান শোনার পূর্বে কখনোই বুঝি নি, আমরা শোষকের জাত, আমাদের যা শেখানো হয়েছে সব ভুল। কখনওই ভাবি নি, আমাদের বাপ দাদারাও ছিলো শোষণের বংশীবাদক। আমাদের মায়েরা, নানীরা, দাদীরা দু'মুঠো ভাতের আশায়, অন্য পুরুষ থেকে নিরাপদ থাকার আশায় দাসত্ব করেছে সারাজীবন। দাসত্বকেই তারা তাদের নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে। যে দাসত্বের নৌকা চালাচ্ছে পুরুষ, সে দাসত্বের দাঁড় টানছে ঐ নারীই -সে কথাও আমাদের বিবেচনায় আসে নি কখনো। কারণ, আমরা দাসত্বে নিগড় থেকে বেরোতে পারি নি কোনোদিন।

তসলিমা এলেন......
আমরা তীব্র ঝাঁকুনি খেলাম, সুনামির মতো তীব্র ঝাঁকুনি। এ সুনামি আমাদের চিন্তার রাজ্য এলোমেলো করে ফেললো। প্রলয়ঙ্করী বন্যার পানিতে ভেসে গেলো আমাদের দূষিত চিন্তার সৌধ সমূহ। গড়ে উঠলো নতুন, পুষ্পিত, নয়নাভিরাম এক ভাবনার শহর। এ ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারে নি জ্ঞান পাপীরা, মুর্খরা এবং শোষকেরা। আসলে এমন একটা সুনামির দরকার ছিলো। হালকা-পাতলা ঝাঁকুনিতে টলানো যায় নি পুরুষতন্ত্রের ইস্পাতদৃঢ় সৌধ। 

তাই তসলিমার দরকার ছিলো। অর্ফিয়াসের বাঁশরী হাতে কালোত্তীর্ণ তসলিমার দরকার ছিলো।

তসলিমা নাসরিন আমাদেরকে জাগিয়েছেন। এখন আমরা নতুন ভাবে, মুক্তভাবে, ডানা মেলে দিয়ে ভাবতে শিখেছি। আমরা আমাদের পুর্বপুরুষের করা অন্যায্য বন্টন প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা সম্পত্তির দ্বিগুণ অংশীদারিত্ব প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা নারীকে পেটানোর লাঠিটা ঘৃণাভরে ভেঙে ফেলেছি। আমরা হাতবদল প্রথাকে চুলোয় দিয়েছি। আমরা দেহের বিনিময়ে খাদ্য নামক ধর্মীয় কনসেপ্টকে তুড়ি মেরেছি।

আমরা তো জেগেছি, তুমি কি জাগবে না ভগিনী? 

আমরা তো উত্তরাধিকার সম্পত্তির বাড়তিটুকু ফিরিয়ে দিয়েছি, তুমি কি নেবে না ভগিনী? আমরা তো লাঠি ভেঙে দিয়েছি, তুমি কি এবার নির্ভয়ে হাঁটবে না ভগিনী? এখন আমরা যদি পূর্বপুরুষের সেই জীনগত বৈশিষ্ট্যে ফিরে পুনরায় লাঠি হাতে নিই, তাহলে তুমিও কি লাঠি হাতে নেবে না? তুমি কি ‘উদারতার উদাহরণ’ দেখিয়ে লাঠির বদলে ফুল হাতে নেবে? কেনো নেবে? আমরা পুরুষষেরা কি হাজার বছর ধরে তোমার প্রতি উদারতা দেখিয়েছিলাম? আমাদের ‘শাসনের লাঠি’ ভেঙে ফেলেছিলাম? 

হে নারী, তোমার প্রাপ্য সম্পদ ফেরত নাও। তোমার লাঠিটাও ফেরত নাও। মনে রাখবে, উত্তরাধিকার সম্পদের মধ্যে দুটো লাঠি ছিলো -একটি তোমার, আরেকটি আমার৷ দুটো বাগান ছিলো -একটি তোমার, আরেকটি আমার। দুটো দীঘি ছিলো -একটি তোমার, আরেকটি আমার। 

তোমার সবকিছু তুমি বুঝে নাও। 

আমার মতো তোমার জন্যেও ছিলো জিন্সের প্যান্ট ও টিশার্ট। আমি দামি, সুন্দর ও মজবুত জিন্সের প্যান্ট এবং টিশার্ট রেখে তোমাকে কিনে দিয়েছিলাম অসুন্দর, সস্তা ও ম্যাড়মেড়ে বোরকা। আজ জিন্সের প্যান্ট-টিশার্টে তোমার অধিকার আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি।

আমি নিজের জন্য মনমতো পোশাক পরতে পারলেও তোমার জন্য নির্ধারণ করেছি ওড়না নামের এক অদ্ভূত পোশাক। তোমার বুকের উচ্চতা নাকি আমার অনুভূতি আহত করে। তাই সে উচ্চতা সমান করার প্রয়াস হিসেবে তোমাকে আমি দিয়েছি ওড়না, আর তুমি সেই ওড়না তথা আমার চাপানো পোশাককেই ফ্যাশন ভাবছো! 

আমার বাপের, দাদার, নানার শিক্ষাটা ভুল ছিলো। বন্টনগুলো অন্যায্য ছিলো। আমি বাপের করা অসম বন্টনের বিরোধিতা করছি। আমি ভাই হিসেবে পাওয়া দ্বিগুণ অংশ ফেরত দিচ্ছি। আমি বীরত্বের তরবারিটা নিয়ে তোমাকে দিয়েছিলাম মেকাপ বক্স, সেটা ছিলো বাপের অসম বন্টনের কারণে। আজ থেকে তরবারি এবং মেকাপ বক্সে তোমার এবং আমার সমান অধিকার। 

আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে প্রস্তুত। আমি ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত। আমি লজ্জা পেতে প্রস্তুত। কেনো তবে তুমি ইতস্তত করছো? তসলিমা নাসরিন বেঁচে আছে, এবং হাজারো তসলিমার জন্ম হয়েছে। কেনো ভয় পাচ্ছো তবুও?

2815 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।