নাদিয়া ইসলাম

নারীবাদী

আমায় ডুবাইলি রে-পার্ট-টু

‘ডুব’ নিয়া আমার প্রাথমিক চিন্তা আমার প্রথম পোস্টেই লিখছি। এই পোস্ট মূলতঃ ‘ডুব’ এর চিন্তাপদ্ধতি নিয়া আমার চিন্তাভাবনা।

আমার ধারণা (এবং বিশ্বাস) ডুবের মূল গল্প কী নিয়া তা সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন মাত্রই জানেন। ডুবের পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আনন্দবাজার পত্রিকায় দেয়া ইন্টারভিউয়ে নিজেই বলছেন, এই গল্প হুমায়ুন আহমেদের জীবন থিকা নেয়া। পরে অবশ্য উনি হুমায়ুন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের সাথে আইনী জটিলতার কারণে বা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসাবে নিজের স্ট্যান্ড পাল্টাইছেন এবং জোর গলায় মিথ্যা বইলা গেছেন এই বইলা যে এর সাথে হুমায়ুন আহমেদের কোনো সম্পর্ক নাই। শিল্পী হিসাবে মিথ্যা বলার অধিকার উনার অবশ্যই আছে, কিন্তু সেইটা অন্য প্রসঙ্গ।

এই গল্প হুমায়ুন আহমেদরে এবং উনার দ্বিতীয় বিয়া ও মৃত্যুরে কেন্দ্র কইরা হোক বা না হোক, আপনি এমনকি নিরপেক্ষভাবে এই ফিল্ম দেখতে গেলেও এর মূল গল্পের সাথে আশ্চর্যজনকভাবে উইমেনচ্যাপ্টারের কর্ণধার ও সম্পাদক সুপ্রীতি ধরের ‘গৃহকর্মী যখন গৃহকর্ত্রী হতে চায়’ লেখার অস্বাভাবিক মিল পাবেন। সুপ্রীতি ধর উনার সেই কুখ্যাত শ্রেণিবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক লেখায় বলছিলেন, কাজের মেয়েদের নজরই থাকে আপনার উচ্চবিত্ত ড্রেসিং টেবিল এবং আপনার উচ্চবিত্ত স্বামীর দিকে। এবং আপনার উচ্চবিত্ত শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট স্বামীপ্রবর কিন্তু নিজ ইচ্ছায় কাজের মেয়ের তেল চিটচিটে বিছানায় গিয়া হাজির হন না, বরং কাজের মেয়েরা ‘ফুসলায়ে’ উনারে সেইখানে যাইতে বাধ্য করেন।

ডুবের চিন্তাপদ্ধতি সুপ্রীতিরে ছাড়াইয়া উপরে উঠতে পারে নাই। ডুবের মূল বক্তব্য এইরকম, জাভেদ হাসান (হুমায়ুন আহমেদের চরিত্রের রূপায়নে ইরফান খান) নিজ ইচ্ছায় তার প্রথম স্ত্রী মায়া (গুলতেকিন খানের চরিত্রে রোকেয়া প্রাচী)-রে ছাইড়া যান নাই, বরং উনার মেয়ের বান্ধবী ও উনার প্রেমিকা নীতু (মেহের আফরোজ শাওনের চরিত্রে পার্নো মিত্র) উনারে ‘ফুসলায়ে-ফাসলায়ে’ দ্বিতীয় বিয়াতে বাধ্য করাইছেন! নীতুরে জাভেদ বাসা থিকা বাইর কইরা দিতেছেন, তারপরেও তিনি দেওয়াল টপকাইয়া জাভেদের বাসায় ঢুকতেছেন, জাভেদ তারে ‘না’ বলার পরেও তিনি ঘুইরা ফিরা জাভেদের পিছে ঘুরঘুর করতেছেন, নানান ছলছাতুরির আশ্রয় নিতেছেন ইত্যাদি। অর্থাৎ ডুব বলতে চাইছে, জাভেদের এই প্রেম করার মোটেও ইচ্ছা ছিলো না, শুধুমাত্র নীতুর উচ্চাকাংখায় জাভেদের সোনার সংসার ভাইঙ্গা ছারখার হইয়া গেছে।

আহারে। (আহারে নামে একটা গানও অবশ্য গাওয়া হইছে ফিল্মে। গানটা ভালো।)

ভাগ্যিস, হুমায়ুন আহমেদ মারা গেছিলেন। নাইলে ফারুকীর মারফত নিজেরে এমন পূতঃপবিত্র ফেরেশতা চরিত্রে দেইখা উনি নিজে নিজেই ‘ডুব’-এ ডুইবা আত্মহত্যা করতেন সন্দেহ নাই!

ডুবের এই ‘বিলো-দ্যা-বেল্ট’ খেলা অতি প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক খেলা। পুরুষতান্ত্রিকতা তার নিজের অবস্থান টিকায়ে রাখতে বিয়ারে অতি পবিত্র এক বন্ধন হিসাবে উপস্থাপন করে। এমনকি এই বিয়াতে যদি নির্যাতন চলে বা যদি এই বিয়াতে ভালোবাসা না থাকে, তাও পুরুষতান্ত্রিকতা দাবী করে স্ত্রী যেন যেকোনো মূল্যে তার সন্তানের মুখের দিকে চাইয়া সেই বিয়া টিকাইয়া রাখেন। এবং যদি কোনো স্বামী এই বিয়াতে থাকা অবস্থায় পরকীয়াতে জড়াইয়া যাইতে ‘বাধ্য’ হন, তাইলে সেই ‘নষ্টামী’ এবং ‘নোংরামী’র দায় সম্পূর্ণই দ্বিতীয় মেয়েটার। কারণ পুরুষ মাত্রই দুধে ধোওয়া তুলশী পাতা ও বাসক পাতা ও দুনিয়ার পবিত্র পাতাদের সমষ্টি।

পরকীয়ারে আমরা খারাপ চোখে দেখি। নিজের মেয়ের বান্ধবীর সাথে পরকীয়া আমাদের চোখে আরো নিকৃষ্ট। আমাদের নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বিয়ারে টিকাইতেই মানুষের বিয়া বহির্ভূত মানবিক প্রেমরে ‘অসামাজিক’ বইলা আখ্যা দেয়, কারণ পুরুষতান্ত্রিকতা শুধু পুরুষের বীর্যের মাধ্যমে উৎপাদিত সন্তানের ‘বংশপরিক্রমা’ নিয়া চিন্তিত, এইক্ষেত্রে মানুষের মানবিক ও স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যরে পাত্তা দিলে তার চলে না। এবং এই সমাজ যেহেতু ক্ষমতা বন্টনের ক্ষেত্রে হায়ারার্কির খেলায় পুরুষরে নারীর চাইতে উচ্চ অবস্থানে রাখে, তাই বিয়া ভাঙ্গার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দায় দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট দুই নারীরে। অর্থাৎ একটা বিয়া ভাঙ্গার ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীরে তার স্বামীরে ‘আটকায়ে’ না রাখতে পারার অক্ষমতারে দায় দেওয়া হয়, এবং প্রেমিকারে দায় দেওয়া হয় ঐ ভদ্রলোকরে ‘ভাগাইয়া’ নিয়া যাওয়ার অসততা এবং অনৈতিক উচ্চাকাংখার চরিত্রের কারণে।

ডিয়ার ফারুকী, পরকীয়া দুইজন মানুষ একসাথে করেন। পরকীয়ায় দুইজন মানুষের সমান অংশগ্রহণ থাকে। এইক্ষেত্রে একজনরে (পড়েন, পুরুষরে) তার ‘নৈতিক স্খলনের’ অসম্মানজনক অবস্থান থিকা বাঁচাইতে একজনের (পড়েন, সেই পুরুষের প্রেমিকার) উপর দায় চাপাইয়া আপনি শুধুমাত্র অনৈতিক এবং অন্যায্য কাজই করেন নাই, বরং আপনি ঐ প্রেমিকার চরিত্রহননের দায়ে দোষী একজন পুরুষতান্ত্রিক মোল্লা- যিনি ব্যাভিচারের জন্য শুধুমাত্র ব্যাভিচারীনিরে পাথর ছুঁইড়া হত্যা করার মতো মান্ধাত্বা ধ্যানধারণায় বিশ্বাস করেন। আপনি ডুবের মাধ্যমে নিজেরে একজন আপাদমস্তক নারীবিদ্বেষী মানুষ হিসাবে প্রমাণ করছেন। আপনারে ধিক্কার। আপনার প্রাচীন চিন্তাপদ্ধতিরে ধিক্কার। আপনার ডুবরেও ধিক্কার।

ফিল্ম হিসাবে ডুব একটা বস্তাপচা পুরুষতান্ত্রিক ও নারীবিদ্বেষী সমাজের পা-চাটা দাস হিসাবে নিজেরে প্রকাশ করা ছাড়া এবং শিল্পের নামে ১২ না ১৩ কোটি টাকার অপচয় ছাড়া তাই আর কিছুই প্রমাণ করতে পারে নাই। শুধুমাত্র ‘আর্ট ফর আর্ট সেইক’ দিয়াও কি ডুবরে ক্ষমা কইরা দেওয়া যায়? না, দুঃখিত। শুধুমাত্র কিছু ভালো সিনেম্যাটোগ্রাফির কাজ, শুধুমাত্র ঝকঝকে ছবি, একটা সুন্দর গান আর সুন্দর মেইকাপ, কস্টিউম এবং সুন্দর সুন্দর দেখতে কিছু অভিনেতার চেহারা দিয়া কি আপনি ভালো একটা ফিল্ম দাঁড় করাইতে পারেন? জ্বি না, পারেন না। অর্থাৎ পারেন নাই। আপনার ফিল্মে ইরফান খানের মতো শক্তিশালী অভিনেতার অতি নিম্নমানের অভিনয়, গল্পের গাঁথুনির অভাব, চরিত্র ডেপেলপমেন্টের পিছনে সময়ক্ষেপন না করা, হুমায়ুন আহমেদ এবং মেহের আফরোজ শাওন দুইজনের চরিত্ররেই অসম্মান করা ইত্যাদির মাধ্যমে আপনি যেই জিনিসরে উচ্চমার্গীয় শিল্প বইলা চালায়ে দিতে চাইছেন, তা যে শুধু মধ্যবিত্ত ও অতি সাধারণ দর্শকের কাছে চলবে না, তা না, তা সোভিয়েত মন্তাজ বা ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম বা জার্মান এক্সপ্রেশনিজম বোঝা ফিল্মবোদ্ধা জনগণের কাছেও চলবে না, বরং নিজ ছাগলামির ওজনে টাইটানিকের মতো ডুইবা যাবে। এখনই যাইতেছে। তাকাইয়া দেখেন।

তাই আপনার সাত নাম্বার ফিল্মের অপেক্ষায় থাকলাম। আশা করি আপনার পরবর্তী আর্ট শুধু অতি আঁতেলিয় প্রথম আলো গং-রে না, বরং পুরা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিরে ভাসাইতে সক্ষম হবে। শুভকামনা।

বিনীত

 নাদিয়া ‘ওরে কেউ একটা মাছ ধরা জাল আন্‌’ ইসলাম।

5793 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।