শামীম আজাদ

কবি, লেখক।

আমার কাছে মানুষ তাদের বেদনার বালুকণা জমা রাখতে আসে

আমাদের শোনাটা হয় না। আমরা খালি বলি আর বলি। কিন্তু অনেক সময় শুধু শুনলেই হয়। আর কিছু করতেই লাগে না।

আমাকে প্রায়ই এ লোক সে লোক যে যুবতী যে বৃদ্ধা এটা সেটা বলতে চায়। পথে, পাঠশালায়, পাবলিক প্লেসে। চেনা এবং অচেনাও। হয়তো লেখা পড়া। অথবা কারো কাছে আমার কথা শোনা- এরা ফোন করে, দেখা করতে চায়, তার নিজের কাহিনী বলতে চায়। বলে, আপা আমিতো লিখতে পারবো না… আপনি লেখেন। ইমেল আসে মেয়েদের কাছ থেকে গোপনে - তাদের নির্যাতনের কথার ফটো প্রমাণসহ। প্লিজ আপা লেখেন। কেউ বলে, আপা আপনাকে আমি এমন স্টোরি দেবো না! নাম কইরা ফেলবেন! এসব শুনে আমি কি করি বা তাদের গল্প শুনে আমি কি করি তা একটু পরে বলছি। তার আগে বলি, এ শুধু আমার পাঠক বা বাঙালি মানুষ না। সেটা করে এদেশের মানুষ ও।

অলিভিয়া পেটকোট লেন মার্কেটে এক জামায়িকান নারী। ক’দিন আগে তার জার্কচিকেন আর লালচে ভাতের দোকান ছিলো। এখন পরচুলার দোকান। খাবারের দোকান থাকতে খাবার কন্টেইনার নিয়ে ভ্যান ডাস্টবিন পেরিয়ে মানুষ তাড়া করার ভান করতো। উচ্চস্বরে কথা বলতো। আঁটো সাঁটো জংলি ছাপ মিনি ও হিল পরেই এমন হাঁটা দিতো মনে হতো তেজী ঘোটকী। তুমুল হাসতো চল্লিশ বা বিয়াল্লিশ বুক কাঁপিয়ে। আমার তখন ডলি পার্টন নয় সোফিয়া লোরেইনের কথা মনে হতো। মনে মনে ডাকতাম ব্ল্যাক সোফিয়া বলে। পেটিকোট লেইন মার্কেট মানেই অলিভিয়ার দৌড়া দৌড়ি জংলি শব্দ আর হাসি।

আমি গরম রোদে এক কাপ কফি নিয়ে ওর পিঠা খেতে খেতেই ভাব হয়ে যায়। খাবার দোকান বাদ দিয়ে পরচুলার দোকান দেবার পর আর বসার স্থান পাই না। কিন্তু ওর পাশেই ঝাকড়া চুলের যে ছেলেটা নাচের তালে তালে ফালাফেল র‍্যাপ বানায় তা আনতে যাই। আর তখন সে দেখলেই হলো, সবাইকে জানান দিয়ে মাথায় সাদা বা সবুজ যে পরচুলাই থাকুক না কেনো তার তোয়াক্কা না করে ওর দোকানের দরোজা থেকে প্রায় বাংলাদেশি পুলিশের চিৎকার উঠে, ঐ রাইটার কাম হিয়ার অর ওয়ান ডে আই উইল এ্যারেস্ট ইউ! লোকজন হতো বিহব্বল হয়ে তাকালে আমি বিনে পয়সায় বিজ্ঞাপন পেয়ে যাই, শি ইজ এ্যা রাইটার। শি শুড রাইট মাই স্টোরি। বুঝুন অবস্থা। আর ওর যা দেহ চাইলে আমাকে পিষে ফেলতেও পারে।

ওলিভিয়া চায় সে যে এক পাকিস্তানীকে বিয়ে করে সব ছেড়ে ব্যবসাপাতি তার হাতে তুলে দেবার পর, পেটে বাচ্চা আসার পর ভেগে যায় তার গল্প লিখি। কিন্তু কি লিখবো? কি করে লিখবো? তার গল্পই শোনার সময় হয় না। আমি কিন্তু বুঝি, আমাকে লিখতেও হবে না। শুধু শুনলেই তার শান্তি হয়ে যাবে।

আমি তাই করবো। যেভাবে অন্যের গল্প ও শুনি। একবার শোনার পর তারা কোনোদিন বলেনি - আপা, আমার গল্পটা কোথায় উঠেছে। আপা লিখেছেন? একটু শোনাবেন? 
সেটাই কথা। একটা বয়সের পর অত বলতে হয় না। শুনতে হয়। শুনতে শুনতে চোখ সজল হয়ে উঠলে তা না মুছে তাকে দেখতে দিতে হয়। বলার পর সে সেই বাঁধ অতিক্রম করতে পারে। তার ক্লোজার হয়। যে জীবন কেবলি জীবিতের জন্য সে দিকে তারা হয়তো আবার তাকাতে পারে।

মানুষ চেনা মানুষের কাছে নিজের অবস্থান টলে যাবে বলে সত্যি কথাটা বলতে পারে না। কারণ সে মানুষ অন্য মানুষের কাছে তার বলা কথা বলে দিতে পারে। তার নাজুক অবস্থান জানলে এমনকি সেও তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে পারে। তাই মানুষ মন খারাপ হলে আকাশের কাছে যায়। বৃক্ষের নিচে বসে। জলের শব্দে শব্দে কেঁদে কেঁদে দূঃখের কথা বলে। নদী না পেলেও চলে। বাথরুমে শাওয়ার ছেড়ে কাঁদে। আমিতো রাগ করলে তাই করতাম। সেই কবে থেকেই। ঝগড়ার মাঝামাঝিতেই কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ করে রণে ভঙ্গ দিয়ে জামা জুতোসহ শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পড়তাম।

অন্য লেখকদের কথা জানি না - আমার কাছে মানুষ তাদের বেদনার বালুকণা জমা রাখতে আসে। লেখকরা আসলে ব্যাঙ্ক হতে পারেন। সিন্দুক হতে পারেন। যেখানে বেদনা গচ্ছিত রাখা যায়।

2855 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।