লাবণী মণ্ডল

নারীবাদী লেখিকা।

আমার মতো কেউ যেন আর সৌদি আরব না যায়!

মধ্যপ্রাচ্যে রিয়াদ নগরীর ঘটনা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। কী নৃশংস ঘটনা! এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের এখানের এলিট শ্রেণির নারী বন্ধুদের ট্রল করতেই দেখলাম, ব্যাপার না- শ্রেণি চরিত্র বলে একটা আছে, তা তো আর ভুলে যেতে পারি না। আমাদের দেশের এলিট শ্রেণির নারী বন্ধুদের ভাবনাটা এমন ‘নারীরা দেশে কাজের বুয়া না হয়ে বিদেশে যায় ক্যান, আমরা তো কাজের বুয়া পাই না’ - এই যে যায় তার জন্যই তাদের ধর্ষণ করা, বিক্রি করে দেওয়া জায়েজ! হায়রে মনস্তত্ব! হায়রে নারীবাদ! যাহোক, বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদন পড়ে আমি রীতিমতো ভড়কে যাই, আমাদের মধ্যম আয়ের দেশ নিয়ে প্রশ্ন জাগে, প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলতে ইচ্ছে করে এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে!

মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাগুলো আমরা আজই শুনছি ব্যাপারটা এরকম নয়, তবুও রাষ্ট্রের কর্ণপাত নেই, কোনো পদক্ষেপ নেই। 

দিনের পর দিন বন্দি করে রাখে নারীদেরকে, যার যখন ডাক পড়ে তখন সে মনে করে এই বুঝি মুক্তি পেলাম, খোলা আকাশের নিচে দু’চোখ মেলে তাকিয়ে কান্নাও করতে চায়- না তা আর হয় না! মুহূর্তের মধ্যেই জানতে পারে, তাদেরকে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নাহার নামের মেয়েটির ভাষ্যমতে, পনেরদিন আটক থাকার পর তাকে যখন বের করে নিয়ে যাওয়ার ডাক পড়লো তখন সে ভেবেছিলো, আমি বুঝি মুক্তি পেলাম, না তাকে বিক্রি করে দেওয়ার জন্যই নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো অন্য জায়গায়। মর্মান্তিক সব বর্ণনা! এখন আমরা কি তাদের এই মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়াকে নিয়ে ট্রল করতে পারি, তাদের বৈদ্যাশ যাবার শখ হয় ক্যা বলে ট্রল করতে পারি, না- না পারি না, কোনো সুস্থই মানুষই তা পারে না।

মধ্যপ্রাচ্যে নারীদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে এর প্রতিবাদে আমাদের তেমন কোনো কথা নেই, বুর্জোয়া মিডিয়াগুলো কিছুটা সোচ্চার হলেও তাদের শ্রেণিচরিত্রের কারণেই তাদের থেমে যেতে হয়। 
কেউ পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে, কেউ নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এটা নিত্যনৈমির্ত্তিক ঘটনা ওখানকার। এইসমস্ত নির্যাতিত নারীদের পক্ষে দেশে ফেরাও সম্ভব হচ্ছে না, আর যারা ফিরছে তাদের গগনবিদারী কান্নার ধ্বনি কি আমাদের কর্ণকুহরে পৌঁছে? এই বধির রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্ণকুহরে পৌঁছে- না পৌঁছে না!

নারীরা কি ওখানে দেহবিক্রি করতে হবে বলে যান- মোটেও না! তারা তাদের শ্রম দিয়ে টাকা উৎপাদন করতে যায়। কিন্তু তাদের পরতে হয় নানান ফাঁদে। যে ফাঁদ থেকে কোনো রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে চলে আসে আমাদের অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, নারী বন্ধুরা। আমাদের দায় আছে এদের পাশে দাঁড়ানোর, এদের পক্ষে কথা বলার- এদেরকে নিয়ে ট্রল করার কোনো এক্তিয়ার আমাদের নেই।

কতটা নির্মমতার মধ্যে এদের পড়তে হয়েছে তা তারাই জানেন। ধার-দেনা করে কোনোরকমে বেঁচে থাকার দায়েই তো বিদেশে পাড়ি জমায়। ওখানে তাদের জীবনের ওপর যখন এরকম পৈশাচিক বর্বরতা চলে আসে তখন বোঝা যায় এই সারাবিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, পুঁজির আগ্রাসন। তাদের শেষ সম্বলটুকু আর অবশিষ্ট থাকে না, পাসপোর্টটাও থাকে না তাদের হাতে! নির্মম বড়ই নির্মম। এই সমাজ, রাষ্ট্র। এই নির্মমতার শেষ বলে একটা কথা আছে বলেই আমরা বিশ্বাস করি।

নির্যাতনের শিকার সেলিনার ভাষ্যমতে, ‘আমার পাসপোর্ট রেখে দিয়েছে মালিক। আমি সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আসি। দূতাবাস থেকে আমাকে আউটপাস দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি একবছর কাজ করেছি। কিন্তু বেতন দিয়েছে তিন মাসের। এর আগে আমি ওমানে ছিলাম। আমি তাদের ভাষা জানি। আমাকে অনেক গালাগালি করতো। খেতে দিতো না ঠিকমতো।’ বুঝতেই পারছেন! যারা নারী শ্রমিক বন্ধুদের দিকে আঙ্গুল তুলছেন তাদের আঙ্গুলের জোরটা জানা খুব দরকার।

পিংকি জানান, সৌদি আরবে যাওয়ার পর জানতেন না কোথায় কাজ করছেন। এলাকার নাম জানতেন না। বাসার মালিকের নামও জানা ছিলো না তার। ভাষাও বোঝেন না তাই, ইশারায় নির্দেশ বুঝে নিয়ে সব কাজ করতেন। প্রতিদিন তিনতলা বাসা, ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে হতো তাকে। প্রতিটি তলার ১০টি বড় বড় রুম ছিলো। এমনকি ছাদও পরিষ্কার করতে হতো প্রতিদিন। তিনি বলেন, ‘সকালে উঠে থালা-বাসন পরিষ্কার করতাম। এরপর সারাদিন পানি দিয়ে ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করতে পুরো শরীর ভিজে যেতো। শুকনা কাপড় পরারও সময় পেতাম না। রাতে ভেজা কাপড়েই ঘুমিয়ে পড়তাম, টের পেতাম না। সকালে ওঠার পর বুঝতাম গায়ের কাপড় ভেজা ছিলো। পরের দিন আবার একই কাজ। এত কাজের বিনিময়ে সকালে একটা আর রাতে একটা রুটি খেতে দিতো। হাতে-পায়ে ধরে ভাত চাইলেও দিতো না। ওরা অনেক ভালো-মন্দ খাবার খেতো, আমাকে দিতো একটা রুটি। আমার মতো কেউ যেন আর সৌদি আরব না যায়’ .... 

বুঝতেই পারছেন পৈশাচিকতা! পুঁজির খেলা সব। এই পুঁজির খেলার খেলোয়াড কেনো আমরা হবো, আমরা প্রতিবাদ করবো, প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। প্রয়োজনে আমরাও অস্ত্র হাতে তুলে নিবো, তাক করবো রাষ্ট্রযন্ত্রের দিকে। তাই নয় কী! দারিদ্র্য বিমোচনের নামে, কর্মক্ষেত্রের নামে এমন অমানবিক কর্মকাণ্ড থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে, নাহলে এর রূপ ভয়ংকর হতে বাধ্য। একইসাথে আমাদের শ্রমিকশ্রেণিকে বুঝতে হবে এই ষড়যন্ত্রের জালকে। শ্রমিকবন্ধুদের জেগে উঠতে। আর সেই দায়টাই আমাদের অর্থাৎ যারা রাষ্ট্র, সমাজকে পরিবর্তন করতে চায়। প্রকৃত অর্থে গণমানুষের কথা বলে, গণ মানুষের পার্টি করেন- তাদেরই নিতে হবে।

1736 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।