আলহাজ্ব মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ

অনলাইন একটিভিস্ট।

আমার খুনের কোনো বিচার চাই না

ভূমিকা : গত ২০/১১/১৭ তারিখে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছিলাম, আমাকে দু’জন লোক মার্ক করছিলো সে বিষয়ে। তখন বিষয়টি খুব বেশি আমলে নিইনি, কিন্তু এর কয়েকদিন পরেই ভারতে অস্ত্রসহ এবিটির স্লিপার সেলের কয়েকজন ধরা পড়লো! এখন সেই দুজন লোকের চাহনি নিয়ে পুরোপুরি সন্দিহান আমি।

আমি ঢাকায় থাকতে শেষের কয়েকদিন ছোট্ট একটি ব্যাগে সবসময় ছুরি নিয়ে ঘুরতাম। আমার ফ্ল্যাটে আমি একাকী থাকতাম, ঘুমের সময়েও বালিশের নিচে ছুরি রাখতাম!

এবার কয়েকটি ভবিষ্যৎ দৃশ্য কল্পনা করে আসি চলুন, যা ২০১৭ এর শেষ নাগাদ কিংবা ২০১৮ এর শুরুতে ঘটতে পারে -

দৃশ্য - ১ : আনসারুল্লাহর প্রথম সফল অপারেশন হলো বিদেশের মাটিতে; মুফতি মাসুদ নামক নাস্তিক খতম! নড়েচড়ে বসলো নিরাপত্তা আধিকারিকরা, নড়েচড়ে বসলো মুক্তমনারা।

দৃশ্য - ২ : নাস্তিক মাসুদের লাশ বাংলার মাটিতে ঢুকতে দেয়া হবে না, ঘোষণা চরমোনাই পীর ও হেফাজতের।

দৃশ্য - ৩ : সব মুক্তমনাদের প্রোপিক পরিবর্তন হয়েছে, অগ্নিঝরা বক্তব্য চলছে প্রত্যকের টাইমলাইনে।

দৃশ্য - ৪ : আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আলোচিত হত্যাকান্ড। বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্লগাররা মিডিয়াতে নানাধর্মী বক্তব্য দিচ্ছে, সবাই দুখ-ভারাক্রান্ত মনে কথা বলছে মিডিয়ার সামনে।
"মাসুদ ভাইকে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম" - উনি শুনলেন না, আরেকটু সাবধানে থাকলে আমরা ভাইটাকে হারাতাম না হয়তো, বলছেন বিখ্যাতরা।

দৃশ্য - ৫ : হেফাজতের সাথে জঙ্গিবাদের সম্পর্কের বিষয়টা খতিয়ে দেখতে বলছেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা।

দৃশ্য - ৬ : ব্লগারদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত ইইউ, জঙ্গিবাদ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারকে অনুরোধ।

দৃশ্য - ৭ : মাসুদ আমার হাত ধরেই নাস্তিক হয়েছে। আহারে বেচারা বড় সাদাসিধা লোক ছিলো, আমার সাথে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতো, পরামর্শ চাইতো - বলছেন মুরুব্বি ব্লগার!

দৃশ্য - ৮ : আইএসের পক্ষ থেকে বিজয়ের হর্ষধ্বনি দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কোনো আলেমও যদি নাস্তিক হয় তাহলে তার এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।

দৃশ্য - ৯ : সরকারের পক্ষ হতে লাশ ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। হেফাজতে ইসলাম, চরমোনাই পীর, ইসলামি ঐক্যজোট এয়ারপোর্টের সামনে বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছে। যেকোনো মূল্যে নাস্তিক মুফতির লাশ বাংলাদেশে প্রবেশে বাঁধা দেয়া হবে - ঘোষণা ইসলামি সংগঠনগুলির।

দৃশ্য - ১০ : বিবিসি বাংলার প্রত্যুষা, প্রবাহ অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনের মতামত চাওয়া হচ্ছে। মুক্তচিন্তার উপর একের পর এক আঘাত আর মেনে নেয়া যায় না, বলছেন বিশিষ্ট নাগরিকগণ।

দৃশ্য - ১১ : একজন মা হারিয়েছে তার বড়ছেলেকে। পাড়ার লোকদের কাছে মুখ দেখাতে পারেনা ছোটভাইয়েরা, বড়ভাই নাস্তিক হয়ে মরেছে তাই!

দৃশ্য - ১২ : আন্দোলন চলছে শাহবাগে। প্রদীপ প্রজ্বলন চলছে, সাথে মুক্তির গান, জাগরণের গান।

দৃশ্য - ১৩ : আনসারুল্লাহর আরো তিনজন সদস্য গ্রেপ্তার। গ্রামেগঞ্জে ওয়াজ চলছে, 'নাস্তিককে কতল করা ফরজ' - বলছেন হুজুররা। আলেমও যদি নাস্তিক হয় তবুও তাকে কতল করা ফরজ, তার ঠিকানা জাহান্নাম - বলছেন ইসলামিক বক্তারা।

দৃশ্য - ১৪ : ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঘোষণা দিয়েছে - কেউ নাস্তিক হলে তাকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তারা ইসলামে ফিরিয়ে নেবে, এবং তাকে টাকাপয়সা দিয়ে পুনর্বাসন করা হবে। এটা নিয়ে অনলাইনে ট্রোল চলছে।

দৃশ্য - ১৫ : একটি ইসলামিক পত্রিকা লিখছে - আল্লাহ, রাসুল (সা.) এবং ওলামায়ে কেরামের শানে বেয়াদবি করার পরিণাম: সম্প্রতি নিহত হওয়া মুফতি মাসুদ আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও আলেমদের শানে সর্বদা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও কটুকাব্য রচনা করতো। অবশেষে প্রাণের ভয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়েছে, কিন্তু আল্লাহর গজব থেকে বাঁচতে পারেনি! (নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তার পাকড়াও অত্যন্ত কঠিন, সূরা বুরুজ - ৮৫:১২)..... 
হে ঈমানদারগণ, সাবধান হও। শয়তানের ধোঁকায় পড়ো না। নাস্তিকদের দুনিয়া আখেরাত উভয়টা বরবাদ। (অতএব হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ, তোমরা শিক্ষাগ্রহণ কর; সূরা হাশর - ৫৯:২)....

দৃশ্য - ১৬ : সবাই চুপচাপ, চারদিকে সুনসান নিরবতা....

দুখের বিষয়, এ দৃশ্যগুলি আমি দেখতে পাবো না, যেহেতু এগুলো আমার মৃত্যু-পরবর্তী দৃশ্য !

ঘোষণা - ১ : আমার হত্যাকান্ডের জন্য কেউ বিচার চাইবেন না, এটা আমার অনুরোধ। দীপনের বাবাও শুরুতে বিচার চান নি, পরে সমাজের চাপে বিচার চেয়েছেন, কিন্তু বিচার পান নি!
মরে গিয়ে আমি কি বিচার দেখবো? আর আমার খুনিকে হয়তো জেল-ফাঁসি দেয়া হবে, লাভ কি? আরো একজন মানুষের (হোকনা সে খুনি) জীবন নষ্ট হবে তাতে।

ঘোষণা - ২ : যেহেতু আমার মৃত্যুতে অনেকের সামনে অনেক সুযোগ খুলবে। কেউ বিখ্যাত হবে, কেউ আন্দোলন করবে, কেউ কাঁদবে। আর সেই আন্দোলন, কান্না, বক্তব্যের ছবি তুলে নিজেকে আরেকটু উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
আমার বলিদানে এত মানুষের উপকার হবে - ভাবতেও খুব ভালো লাগছে!
অনেকে এখন থেকেই হয়তো বক্তব্য রেডি করে রাখছেন, মাসুদের মৃত্যুর পরপর কি বক্তব্য দেবেন সেটা! আর না করলে দ্রুত করে নিন, আমার আয়ুষ্কাল দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।

ঘোষণা - ৩ : ভয়ংকর ঘাতকদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি, কার্তুজ ও চাপাতির বিপরীতে আমার অস্ত্র শুধুই কলম। আমি তাদের গোমর জানি বলেই তারা চুপচাপ থেকে নিরবে ঘাতক পাঠাচ্ছে! আমি আর কি কি ফাঁস করবো সে ভয়ে তারা অস্থির। এ লড়াইয়ের ময়দানে আমি নতুন সৈনিক, তবে শত্রুর দৃষ্টিতে খুব খতরনাক। এ লড়াইয়ে জীবন গেছে আমার ভাই অভিজিত, নিলয়, ওয়াশিকুর, অনন্তসহ অনেকের। আমি তখন নিরবে কেঁদেছি, পেশাগত কারণে চুপ থাকতে বাধ্য ছিলাম।

ঘোষণা - ৪ : চাপাতিওয়ালারা আমার কাছাকাছি পৌঁছেছে, অবশ্য ছয়জন বাংলাদেশি চাপাতিবাজ পিস্তলসহ ধরা পড়েছে ভারতে। আমার জীবনে কোনোও নারী জড়িয়ে নেই এখন, জড়াবেও না। 
একাকী মৃত্যুবরণ করতে চাই, কাউকে নতুন করে কাঁদাতে চাই না।

ঘোষণা - ৫ : অনুভূতি এবং আবেগ জাগ্রত করতে আমরা বাঙ্গালি জাতি রক্তের অপেক্ষা করি, এটা জাতি হিসেবে আমাদের গৌরব!
আমার রক্ত দিয়ে কারো আবেগ জাগ্রত করার দরকার নেই, কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকুন। 
আমার হত্যাকান্ডের বিচারের দাবি মওকুফ করে দিলাম। কেউ বিচার চাইবেন না দয়া করে (এ ঘোষণাটি পুনরায় দিলাম!)

বি:দ্র: পৃথিবীর সব মুক্তমনাদেরকে ভালোবাসি, কারণ তারা সত্যিকার অর্থেই মানুষ। মোল্লাকালে মোল্লাদের যে নষ্টামি দেখেছি, নাস্তিকদের মধ্যে তার সিকিভাগও পাই নি।
কাউকে ছোট করা, উদ্দেশ্য করা, অসম্মান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার মৃত্যু-পূর্ব নোট বলতে পারেন এটাকে।

3741 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।