পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ স্বামী আছে। খারাপ স্ত্রীও অগণিত। কিন্তু এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে খারাপ পিতা একটিও নেই, নেই কোনো কু-মাতা। দুনিয়ার সব সন্তানের কাছে তার বাবাটিই শ্রেষ্ঠ, তার মায়ের মতো আর কেউ নয়। অথচ আমাদের দাম্পত্য হিংসা বিদ্বেষে তুরুপের তাসের মতো জিম্মি করি আমাদের সন্তানদের।
স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা ছাড়া কোনো সন্তান জন্ম নেয় না, নিতে পারে না। হতে পারে খুবই ক্ষণস্থায়ী, খুবই পেশাদার, তবুও ভালোবাসাবাসির সুন্দর সেই মুহুর্তের মাঝেই ওরা আসে আমাদের জীবনে। পরম করুণাময় দয়া করেন বলেই ওরা এসে আমাদের যৌথ খামারে গোলাপ ফোটায়, পাখি ডাকায়। বিশ্বসংসারের সব আলো জ্বালিয়ে ওরা আমাদের জীবনটা আলোকিত করে রাখে। সেই আলোর টুকরো, ফুলের হাসি গুলোকে তছনছ করি আমাদের বিষাক্ত দাম্পত্যের ঝড়ে।
দাম্পত্য বিচ্ছেদের পর সন্তানের কাস্টডি মামলা করে মায়ের বুক থেকে সন্তান কেড়ে নেয় হিংস্র পুরুষরা, মায়ের কান্না ইথারে বিথারে ভেসে বেড়ায়। আবার অনেক নারীও শুধুমাত্র নিজের ইগোর জন্য, প্রতিশোধের অস্ত্র হিসেবে বছরের পর বছর সন্তানকে পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেন, বাবাকে সন্তানের সাথে দেখা করতে দেন না। মনে করেন সন্তান কেড়ে নেয়াটাই উনার উপযুক্ত শাস্তি। কি ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা! কি নির্মমতা! মানুষ এতো নির্মম হবে?
কথায় কথায় যে আমরা বলি, বাচ্চাদের জন্য নাকি এই সংসারে আছি, আসলে সন্তানদের দাম্পত্য সংকটের বলি বানিয়ে সন্তানের কোনো স্বার্থে কলহের সংসার ধরে রাখি আমরা। আমাদের অসুস্থ অনিয়ন্ত্রিত দাম্পত্যের রেষারেষিতে সন্তানের সামনে নিজেরা মারামারি করে, মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে কেড়ে নিয়ে, বাবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে, নিজদের ইগোর জন্য সন্তানকে আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে সন্তানের কোন কল্যানের কথা বলি আমরা?
যখন আমরা সন্তানের সামনেই তাদের মাকে বেশ্যা ডাকি, সন্তানের সামনে বাবাকে লম্পট বলে প্রমাণ করি তখন আমাদের নৈতিক অবস্থানও যে তাদের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় তা কি একবারও ভাবি? যে সন্তান মা বাবার পারষ্পরিক চরিত্রহননের প্রক্রিয়ার সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায়, সে কি পরিমাণ নিরাপত্তাহীনতার ভেতরে বড় হতে থাকে তা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। একটু ব্যক্তিত্ব, একটু মানবিক বোধ দরকার হয়।
অভিজ্ঞতা মানুষকে অনেক কিছু রিভিউ করতে শেখায়। পনের বছরের অসংখ্যবার দাম্পত্যে সংকট-আপোস-মিমাংসার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়েছি। এই প্রক্রিয়ার ভেতরে নিজে জ্বলেছি, জ্বালিয়েছিও। কিন্তু যে মহা মূল্যবান শিক্ষা আমি অর্জন করেছি তা হলো, আমরা দু’জন আলাদা মানুষ, আমাদের জীবনও আলাদা। কিন্তু সন্তান আমাদের দু’জনের। যতদিন একসাথে থাকবো সন্তানের সর্বোচ্চ ভালোটুকু নিশ্চিত করেই থাকবো। আলাদা হলেও সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিত করেই হবো।
তাই দাম্পত্য সংকটের যে কোনো পরিস্থিতিতে আমি বাচ্চাদের ভালনারেবিলিটিটুকু মাথায় রাখি। পরিস্থিতি যতো খারাপই হোক না কেনো, বাবার কাছ থেকে বাচ্চাদের দূরে সরাই না। তুমুল ঝগড়ার পরেও বাবাকে বাসায় ফিরতে দেখলে, বাবাকে কাছে পেলে ওদের চোখে যে আত্মবিশ্বাস আমি দেখি তা আমার কাছে অমূল্য।
নিজের জীবনের এবং আমার গত পাঁচ বছরের শিশু মনস্তত্ব নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, দয়া করে দাম্পত্য সংকটের যে কোনো পরিস্থিতিতে সন্তানের ভেতরে 'সেন্স অফ সিকিউরিটি'র অভাব তৈরি করবেন না। এমন কি আলাদা হয়েও যদি যান, সন্তানকে এই নির্ভরতাটুকু দিন যে, আপনারা দু’জন মানুষ আলাদা থাকছেন, কিন্তু বাবা-মা হিসেবে আপনারা দু’জনেই তাদের সাথে আছেন। সন্তানকে আস্থা দিন, নির্ভয় করুন যেনো আপনাদের আলাদা হয়ে যাওয়া তাকে ইন্সিকিউর না করে।
কোনো অবস্থাতেই সন্তানের কাছ থেকে মাকে কিংবা বাবাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার অধিকার আপনার নেই। আপনি তা করতে পারেন না। ভুলে যাবেন না, মা –বাবা দুজনের সান্নিধ্য পাওয়া শিশুর প্রথম অধিকার। আপনার ইগোর জন্য সন্তানকে ‘হয় বাবা, নয় মা’ এই অপশন দিয়ে ছোট্ট বাচ্চাটাকে একটি ভয়ঙ্কর মানসিক অবস্থার মধ্যে ফেলে দেওয়ার আগে নিজে ভাবুন, কেউ যদি আপনাকে দুটো সন্তানের একজনকে বেছে নিতে বলে আপনি কি করবেন?
হতে পারে আপনার স্ত্রী আপনার প্রতি বিশ্বস্ত নয়। হতে পারে আপনার স্বামী বহুগামী। কিন্তু ভুলে যাবেন না, এই মানুষটি আপনার সন্তানের মা/বাবাও। কোনভাবেই তাকে সন্তানের কাছ থেকে আলাদা করার অধিকার আপনার নেই, নেই সন্তানের সামনে তাকে ছোট করার অধিকার। এই মানুষটির সম্মানের সাথে আপনার সন্তানের সম্মান, ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস নির্ভর করে। তাই শুধুমাত্র ইগোর জন্য সন্তানের সামনে তার বাবা/মাকে অপমান করে নিজেকে ছোট করবেন না প্লিজ।
মনে রাখবেন, মায়ের কোল এবং বাবার ঘাড় ছাড়া কোনো সন্তান বিকশিত হয় না। কেবল শরীরে বড় হয় বা অতিজোর কিছু 'পরীক্ষা পাশ' করতে পারে। তাই জেদের বশে সন্তানকে বাবার সাথে দেখা করতে না দেয়া কিংবা হেডম দেখানোর জন্য সন্তানের কাস্টডি নেয়ার চর্চা বন্ধ করুন। নিজেদের ইগোর কাছে সন্তানকে জিম্মি করা থামান।
কোনো অবস্থাতেই বাচ্চাদের সামনে বাবা কিংবা মা সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলবেন না। আমার সংসারে যতো বড়ো ঝড়ই উঠুক না কেনো, আমি মনে রাখি এই মানুষটা দিন শেষে আমার সন্তানের পিতা। সন্তানের সামনে বসে পিতার নামে কুৎসা গাই না আমি কখনোই। সন্তানদের এলাউ করি না বাবা সম্পর্কে অসম্মানজনক মন্তব্য করতে। আমি বিশ্বাস করি, স্বামী খারাপ হতে পারে, পিতা কখনো নয়।
ভুলে যাবেন না, শিশুদেরও নিজস্ব বিবেচনাবোধ আছে। তারা বুঝে অনেক বেশি, প্রকাশ করে কম। আজ হয়তো আপনি যা বোঝাচ্ছেন তা সে মেনে নিচ্ছে, কিন্তু কাল সে ঘুরে দাঁড়াবে আপনার দিকেই। মনে রাখবেন, আজকে আপনি যদি বাচ্চাকে তার বাবা কিংবা মা’কে অসম্মান করতে শেখান সে কিন্তু একদিন বুমেরাং হয়ে আপনার দিকেই তেড়ে আসবে, আসবেই। এটা প্রকৃতির প্রতিশোধ, মিস হবে না।
সবশেষে বলি, দাম্পত্য কিংবা একত্রবাস, যাই হোক না কেনো, টানাপোড়ন, সংঘাত, সংকট সব সম্পর্কের চরম বাস্তবতা। এখানে লকোচুরির কিছু নেই। দু’জন মানুষ একসাথে থাকতে গেলে ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয়, আবার মিটেও যায়। কখনো এই সংঘাত দু’জনের পথকে আলাদা গন্তব্যেও নিয়ে যায়। কিন্তু এই যাওয়া আসার মধ্যের সময়টুকুতে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে থাকে যে ছোট্ট প্রাণ সে প্রাণ আমাদেরই তৈরি করা।
এরা আমাদের সন্তান। আমাদের ভালোবাসার আমন্ত্রণে এসে ফুল ফোটানো এই জীবনগুলো আমাদের হাতেই যেনো নিপীড়নে নিস্তব্ধ হয়ে না যায়। আমাদের সম্পর্কের সংকটের আগুনে পুড়ে যেনো না যায় আমাদের সন্তানদের শৈশবের সবুজ বাগান আর হাসি আনন্দ। আমাদের জীবন যার যার, কিন্তু সন্তান দুজনের। সুতরাং যৌথযাপন কিংবা আলাদা যেভাবেই থাকি না কেনো, প্রতিটি শিশুর জীবন কাটুক বাবা-মায়ের উত্তাপে।
বাবা কিংবা মাকে ছাড়তে বাধ্য হওয়া কোনো সন্তানের দীর্ঘশ্বাস না জমুক আমাদের ঘাড়ে। কোনো শিশুর বিষন্ন নিঃশ্বাসের ভারে যেনো অভিশপ্ত না হয় এই পৃথিবী। আমাদের সন্তান থাকুক দুধে ভাতে।