খান আসাদ

সমাজকর্মী

"আমাদের" সংস্কৃতি আর "ওদের" সংস্কৃতি…

আমাদের সংস্কৃতিতে আমরা প্রকাশ্যে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাই না। প্রিয়জনকে আলিঙ্গন করি না, পাবলিক প্লেসে চুমু খাই না, শর্টস বা বিকিনি পরে কক্সবাজার বীচে যাই না। আমরা "সভ্য"।

ওদের সংস্কৃতিতে ওরা, রাস্তায় প্রিয়জনকে আলিঙ্গন করে, এয়ারপোর্ট বা রেলস্টেশনে চুমু খায়, বিকিনি পরে রোদে বা স্নানে যায়, এমনকি মেয়েরা গরমের দিনে রাস্তায় ক্লিভেজ দেখা যায় এমন জামা কিংবা নিতম্বের কিছু অংশ বের করা হট প্যান্ট পরে। ওরা আমাদের মতো "সভ্য" হয় নি। ওরা "পশুর" মতো শরীর দেখিয়ে বেড়ায়।

ফেসবুকে আপনারা যাদের "ছাগু" বলেন, তাদের কাছ থেকে, এই "সভ্য" ও "পশুর" পাশবিক যুক্তি আপনারা অনেক শুনে থাকবেন।

কিন্তু আমি একদা এই যুক্তি বাংলাদেশে নিয়মিত টকশোতে জ্ঞান দেয়, এরকম একজন "প্রগতিশীলের" কাছ থেকেই শুনেছি। ঢাকা বিমানবন্দরে, এক সকালে, একজন বিদেশিনীর হাঁটুর নিচে পর্যন্ত স্কার্ট পরা থাকার পরেও, এই যৌনবঞ্চনা, যৌন অতৃপ্তি ও বর্নবাদী বিদ্ধান লোকটির কথা শুনে আমি হতবাক ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম। আমি তাঁকে বলেছিলাম, সমস্যাটা তাঁর মগজের। সে একজন "সেক্সিস্ট"।

অন্য জরুরি কাজ ফেলে, এই নিয়ে কথা বলছি, কারণ কেবল "ছাগুরা" নয়, প্রগতিশীল বলে ধারনা করি, এমন অনেকেই, এই "আমাদের" এবং "ওদের" সংস্কৃতির তুলনাটা করে, "আমাদের সংস্কৃতির" জয়গান গাইছেন।

একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেই দেখবেন, আমাদের সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষদের মধ্যে শিশুকে প্রকাশ্যে মায়ের দুধ খাওয়ানোর প্রচলন ছিল। চল্লিশ বছর আগের গ্রামে, পুকুরে কোমর সমান জলে দাঁড়িয়ে জলের উপর ভাসিয়ে কাপড় ধুতে আমি নিজেই দেখেছি।

প্রশ্নটা, শরীরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। "যৌনবাদী" না কি "মানবিক"।

এই দৃষ্টিভঙ্গি, "আমাদের" সংস্কৃতিতে এবং "ওদের" সংস্কৃতিতে সব সময় একই রকম ছিলো না, সবার মধ্যে তা একই রকম ভাবে থাকে না, এবং এই দৃষ্টিভঙ্গিটি ভবিষ্যতে বদলাবে। "আমাদের" যেমন, তেমনই "ওদের" মধ্যেও অনেকে যৌনবাদী আছে। আমাদের এখানে একটু বেশি আরকি।

শরীরের প্রতি অনেক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী থাকতে পারে। (১) আত্মীয়তার : মা, বোন, ভাবী, ভাসুর, বন্ধু, প্রতিবেশী বা প্রেমিক প্রেমিকা। এই দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারন করে দেয় আমাদের পারস্পরিক আচরণ।(২) বৈজ্ঞানিকের : ডাক্তারদের ক্ষেত্রে যে কোনো শরীর নানা অঙ্গপ্রত্যগের সমাহার ও আভ্যন্তরীণ নানা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ব্যাবস্থা মাত্র।(৩) শিল্পীর : কবি বা চিত্রকর শরীরের নান্দনিক স্বরূপ আবিষ্কার করে। শরীর প্রকৃতির আর পাচটি বিষয়ের মতোই এদের কাছে।(৪) আধ্যাত্মিক : মানুষের শরীর ঈশ্বরের অধিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির বা গির্জার চেয়েও পবিত্র। শরীরকে পূজা করা যায়।

সবশেষে, ৫ নম্বরে আরেকটি আছে, "শরীর মানেই যৌনবস্তু"। এই ধারনাটি সকল ছাগুদের, সকল ধর্মের মৌলবাদীদের, সকল বিকৃত মানসিকতার যৌনরোগীদের।

কোলকাতায়, তরুণ তরুণীর আলিঙ্গন দেখে যে লোকেরা উত্তেজিত হয়, সেটার কারণ এরা এখনো "ভালোবাসার" বদলে "যৌনতা" দেখে। সমস্যাটা এদের মগজের। এবং হ্যাঁ, আমাদের সংস্কৃতিতে এই "যৌনবাদী" দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল, এটি নিয়ে কথা বলা কঠিন, কারণ যারা বলবে, তাদেরও অনেকেই এই "যৌনবাদী" দৃষ্টিভঙ্গিতেই আটকে আছে।

এই "যৌনবাদী" দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নারীর প্রতি সহিংসতার সম্পর্ক আছে। নারীর শরীর আড়াল করে নয়, নারীর শরীরকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশ দরকার।

1752 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।