শাওন মাহমুদ

শহীদ কন্যা

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা "আলতাফ মাহমুদের শেষ কয়েক ঘণ্টা"

২৯ অগাস্ট। ১৯৭১। উদ্ভ্রান্ত, উষ্কখুষ্ক, অশান্ত সারাদিন। ক্র্যাক প্লাটুন এর অনেক গেরিলা যোদ্ধা আজ ধরা পড়েছে। উঠোনে মাটিচাপা দেওয়া অস্ত্রভর্তি ট্রাঙ্কগুলো নিয়ে সবচেয়ে বড় চিন্তা। আগামী অপারেশনে অস্ত্রগুলো কাজে লাগাতে হবে। বাসায় যদি আর্মি রেইড করে তাহলে এগুলোর কি হবে?

সারাদিন কালো মরিস গাড়ি করে কোথায় কোথায় ঘুরেছিলো সে, কে জানে! হয়তো বা অস্ত্র রাখবার জন্য নিরাপদ কোন জায়গা খুঁজেছিলো। সারাদিন পর রাত ১১ টায় বাড়ি ফিরে আসার পর মা বলেছিল, ভাত দেবো? ভাতপ্রিয় আলতাফের খিদে ছিলো না, একদম না। তাই জবাবে বলেছিলো, পেট ভরা, খাবো না। শোবার ঘরে শাওন আর ঝিনু ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সন্তর্পণে সেই ঘরে ঢুকে কি করেছিলো আলতাফ? কেউ জানে না। হয়তো বা নির্ঘুম চোখে সারারাত পরিবারের সবাইকে পাহারা দিচ্ছিল, কে জানে!

আজান দেবার পর ৩০ অগাস্ট ভোরবেলার কথা সবার জানা। ঘর ছেড়ে যাবার আগে কখনো ভাবেনি সে, এ জীবনে আর ঘরে ফেরা হবে না। একসাথে ভাত খাওয়া হবে না। কখনও না।

৩৭০ আউটার সার্কুলার রোড থেকে সোজা নাখালপাড়া এমপি হোস্টেল-টর্চার সেল থেকে ইন্টারোগেশন চেম্বার। ক্ষতবিক্ষত আলতাফ পানি চেয়েছিলো, তাঁর মুখে পেশাব করেছিলো পাকসেনারা। অত্যাচারের পালা শেষ হলে ছোট বাথরুমটায় গাদাগাদি করে ঢুকিয়ে দিতো অনেকের সাথে। একটা পানির কল ছিলো, শক্তি ছিলো না সেটা ছেড়ে পানি খাওয়ার মতো। সাথের সাথীরা একজন অন্যজনের জন্য সাধ্যমত করতো। আজলা ভরে পানি খাইয়েছিলো তাদেরই কেউ। রাত ১০টার পর সবাইকে ট্রাকে করে রমনা থানায় পাঠানো হয়। সেখানে সাধারণ কয়েদীরা তাদের ভাগের শুকনো রুটি আর ডাল খেতে দিয়েছিলো সে রাতে। সেদিন আর আলতাফের খাওয়া হয়নি, ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে জ্বরের ঘোরে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।

পরের দিন আবার সকাল ১০ টায় এমপি হোস্টেল-টর্চার সেল থেকে ইন্টারোগেশন চেম্বার। মুখ খোলাবার জন্য আলতাফকে কয়েক ঘণ্টা পর পর টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। এক সময় অধৈর্য্য হয়ে পাকসেনারা তাঁর পা ফ্যানের রডে বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে বেধড়ক পেটায়। আর তখনই হাঁটু, কনুই আর পাঁজর ভাঙ্গে আলতাফের। গরম পানি দিয়ে ঝলসে দিয়েছিলো শরীরের বেশীর ভাগ অংশ। ফোঁসকা পরেছিলো গায়ে।

একটা নাম, শুধু একটা নাম চেয়েছিলো ওরা। একেবারেই বেঁকে বসা দীর্ঘদেহী সুঠাম শরীরের আলতাফ মুখ খোলে নি, শেষ পর্যন্ত না। এভাবেই রাত হয়, ১০টায় আবার রমনা থানায় পাঠাবার আগ মুহূর্তে পাকসেনারা ঠিক করে ফেলেছিলো কাকে ছাড়বে আর কাকে নয়।

রমনায় বেশ রাতে এক আর্দালি ভাত আর পেঁপে ভাজি খেতে দিয়েছিলো কি মনে করে কে জানে। সবাই মিলে ভাগ করে খাবার আগে রক্তাক্ত আলতাফ খোঁড়াতে খোঁড়াতে দেয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে গরাদের কাছে গিয়ে ঐ আর্দালিকে বলেছিলো, একটা কাঁচা মরিচ হবে? আর্দালি এনে দিয়েছিলো একটা মরিচ।

আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই দীর্ঘদেহী আলতাফ নুয়ে পড়ে টিনের থালায় ভাত আর পেঁপে ভাজিতে কাঁচা মরিচ মাখিয়ে লোকমা তুলে তৃপ্তি করে খাচ্ছে। কপালের চামড়া বেয়োনেট এর আঘাতে ঝুলে আছে, প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে খোলা মুখের সামনের পাটির দাঁতগুলো ভাঙ্গা। শেষবারের মতো সবাইকে নিয়ে ভাত খাচ্ছে আলতাফ- হাতের আঙ্গুলে জমে থাকা রক্ত দিয়ে সাদা ভাত লাল, সাথে সবুজ কাঁচা মরিচ।

2460 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।