মাসখানেক আগে ফেইসবুকে পাবলিক পোস্টে কী এক সাধু নামক ভদ্রলোকের সাথে বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি হেনতেন নিয়া তর্কাতর্কি হইতেছিলো। তর্কের এক পর্যায়ে ভদ্রলোক উত্তেজিত হইয়া আমারে বলতেছেন, “আপনার লেখার বিষয়বস্তু থার্ডক্লাস হলেও তাও চলে, মাঝেমধ্যে পড়াও যায়- কিন্তু আপনি যেসব পোশাক পরেন, তাতে আপনাকে সস্তা বাজারী মেয়ে ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না!”
আমি উনার কথায় দাঁত বাইর করা হাসির একটা ইমো দিলাম। যুক্তিতে না পারলে মেয়েদের চরিত্রই পুরুষতন্ত্রের যুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার এই কথা আমি আজকে থিকা তিন চৌদ্দং পঞ্চাশ প্লাস টু বছর আগে থিকা জানি। সুতরাং উনার কথায় আমার এবং আমার চরিত্রের কিছুই বাল ছিড়া যায় নাই। কইলাম, “চাচু, আমি দেখতে চাউলের বস্তার মতো হইলেও আমি নিজে তো চাউলের বস্তা না যে, আমার দাম বাড়া কমায় দেশ সমাজ জাতির এবং সর্বোপরি আপনার বা আমার কিছু যাবে আসবে। আমি কাপড় খুললেও আমি যেই মহিষমর্দ্দিনীরূপিণী তিমির, তেমনি আমি তিপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল গজের কাপড় দিয়া নিজেরে চৌদ্দশ বছর প্যাঁচাইয়া রাখলেও মগবাজার চৌরাস্তার প্রচারবেদীতে দণ্ডায়মান সেই একই নারীমূর্তি তিমির। সুতরাং আপনার মতো পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ আমারে একবার সুখী তৃপ্ত গৃহস্থকন্যা বা সতীসাধ্বী পতিব্রতা- বাংলা ফিল্মের শাবানা টাইপ আহ্লাদে গদগদ- ভক্তিরসে টসটস টসটস ‘ম্যাডোনা’ বানাইলেও আমার চরিত্রের কিছু যায় আসে না, আরেকবার আমারে বাজারী, সস্তা, লজ্জাহীনের মতো পুরুষের সাথে রংঢং ও নৃত্যগীত কইরা বেড়ানো স্বেচ্ছাচারী বিদ্রোহী ব্যাভিচারি ‘হোর’ বানাইলেও আমার চরিত্রের কিছু যায় আসে না। বাকস্বাধীনতা নিয়া আলোচনা করতে চাইলে করতে পারেন, আদারওয়াইজ ফুটেন, ফুঃ!”
ভদ্রলোক আর আমার ‘ফুঃ’ এর পরে কথা বাড়াইলেন না। তা উনি কথা বাড়াইবেনই বা কীভাবে? ‘চরিত্র’ মারণাস্ত্রের পরে পুরুষতন্ত্রের তো আর কোনো অস্ত্র নাই হাতে হিহি!
যৌনতার ইতিহাস দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় সারা পৃথিবীর পুরুষকূলের কাছে নারীরে পায়ের নিচে রাখার চেষ্টার ক্ষেত্রে চরিত্র, কুমারীত্ব, সতীত্ব ইত্যাদি শব্দের বড়ই কদর। এই সমস্ত ক্ষেত্রে ঢাকা টু টিম্বাকটু বা কলকাতা টু লন্ডন কোথাও তেমন কোনো পার্থক্য নাই। পুরুষতন্ত্রের ‘আগমন’ এর পরে সারা পৃথিবীর পুরুষ নিজেরা কিম কার্দাশিয়ানের স্তনের মাঝখানে দিরহাম গুঁইজা দিয়া, মদের আসরে ঝুমঝুমি পরা বাঈজী নাচাইয়া, শিশু এবং কিশোরীদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য কইরা, পামেলা এন্ডারসনের পাছার মাপজোক কইরা, প্লেবয়ের পাতা স্টার্চে ভিজাইয়া, চটি সাহিত্যে মা খালা চাচী মামী সবাইরে এক বিছানায় শোওয়াইয়া, উনাদের পিনোন্নত স্তন আর গজগামিনী মার্কা পাছা দোলানো সাহিত্য চোদাইয়া, ‘শয়নে স্বপনে গমনে কিশোরী- ভোজনে কিশোরী আনে, করে করে বাঁশি- ফিরি দিবানিশি- কিশোরীর অনুরানে’ গান গাইয়া বাড়ি ফিরা উবু হইয়া গলায় গামছা দিয়া স্ত্রীর দুই পায়ের ফাঁকে ম্যাগনেফাইয়িং গ্লাস লইয়া ‘হাইমেন’ এর সন্ধান করছেন। বিয়ার রাত্রে স্ত্রীর পা বাইয়া পড়া রক্তের সন্ধান করছেন। ধর্মের দোহাই দিয়া, নিজেদের পৃথিবীশ্রেষ্ঠ আইনপ্রণেতা বানাইয়া ‘আটে গৌরী, নয়ে রোহিণী, দশে কন্যকা, তারপরেই রজস্বলা’ আউড়াইতে আউড়াইতে সমাজে নারীর কুমারীত্বের চাষ করছেন। চৌদ্দ হাজার মুকুলিকা বালিকাবয়সী কুমারী বিয়া করছেন। এবং তারপর উনাদের নিয়ম কইরা সময়মত ‘সতী’ এবং সময়মত ‘বেশ্যা’ বানাইছেন।
কিন্তু দিন তো এখন পাল্টাইছে পুরুষতান্ত্রিক চাচাজান। আমি আজকে আর লজ্জাশীল ক্রন্দনশীল মূর্ছাশীল বমিশীল অশিক্ষিত কচি কচি বেনী দোলানো লাল নীল রেশমী ওড়নায় ঢাকা নতুন নতুন বুক গজানো আনতনয়না পতিব্রতা স্ত্রী না যে জানলার গরাদ ধইরা আকাশের পানে তাকাইয়া এমন মৃদু সুরে মিউমিউ কইরা ‘পতি ধর্ম পতিকর্ম, পতি সারৎসার’ গাইবো যে তাতে পতির গুণও গাওয়া হবে, নিজের সৎচরিত্রও প্রকাশ পাবে, অথচ উনার দেশ ও জাতি উদ্ধারকারী ঘুমেরও ব্যঘাত ঘটবে না! জ্বি না। দিন ইদানিং এত সহজ না।
আমি বিশ্বাস করি, আধুনিক যুগে, অর্থাৎ আজকের দিনে যৌনতার ক্ষেত্রে ‘চরিত্র’ নামক গায়েবী শব্দের আর প্রয়োজনীয়তা থাকা উচিত না। কে সতী বা কে বেশ্যা সেইটা যিনি সতী বা যিনি বেশ্যা তিনি নিজে জানলেও চলবে। সমাজের (পড়েনঃ পুরুষের) জানার প্রয়োজন নাই একজন নারী সতী কিংবা বেশ্যা কীনা। একজন মেয়ে যেমন বিয়া করার আগে উনার হবু স্বামী কয়জনের সাথে শুইয়া কয়জনের কৌমার হরণ কইরা আসছেন বা কয়জন টিনা মিনা সখিনার কথা ভাইবা ও কোন্ পাশের বাড়ির ভাবীর রঙ্গিন ছবি দেইখা রাত্রে বিছানা ভিজাইছেন তার হিসাব করার সুযোগ রাখেন না, তেমনি পুরুষরেও সেই সুযোগ নেওয়া থিকা আটকাইতে হবে।
সো ফাকিং হোয়াট আমি একজন বেশ্যা? সো ফাকিং হোয়াট আমি সৌন্দর্য্য প্রতিযোগিতায়, সিনেমায়, ক্লাবে নিজের শরীর বেঁচি? শরীরে কী পাপ হে, বিশুদ্ধতাবাদী? কই আপনার পুরুষ শরীর যে ষোল হাজার রমণীরে নরকাসুর থিকা উদ্ধার কইরা এবং উনাগোর অষ্টভার্যা লইয়া ঢিস্টিং ঢিস্টিং নাচনকুদনের পরেও পবিত্র থাকে, তার রহস্য কী? কই আপনার পুরুষ শরীর যে এগারো বিবাহ করার পরেও পূতঃপবিত্র থাকে, তার রহস্য কী? আপনার শরীর কি মঙ্গল গ্রহের স্পেশাল লাল মাটি দিয়া বানানো?
আধুনিক নারীবাদীদের অনেকেই সৌন্দর্য্য প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে। উনারা কন, নারী ক্যানো পণ্য হবেন? নারী ক্যানো পুরুষের সামনে নিজের বুক পাছা উরুর মাপ দিয়া ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড হবেন? আমি বলি, ক্যানো হবেন না? ক্যানো মেয়েরা পর্দানশীন থাকবেন? ক্যানো মেয়েদের শুধুই সন্তান কোলে জননীর বেশে বা বধূ সাজে গৃহস্থালি কাজে বা দশভূজা হইয়া অফিসের ফাইলে সই কইরা বাড়ি ফিরা স্বামীর সামনে ঠ্যাং মেইলা ‘ওয়াই’ শেইপে নিঃশ্বাস বন্ধ কইরা শুইয়া পড়বেন? আধুনিক পুঁজিবাদী পৃথিবীতে সকল কিছুই পণ্য। নারী- পুরুষ- ট্রান্সজেন্ডার- শিশু- বৃদ্ধ- গাড়ী- ঘোড়া- বিস্কুট- জ্ঞান- বুদ্ধি- শরীর- সাবমেরিন- হেলিকপ্টার- মায়ের দুধ সব কিছুই পুঁজিবাদী পৃথিবীর পণ্য। আজকে জনি ডেপ, সালমান শাহ, জর্জ ক্লুনি, ব্র্যাড পিট, রিচার্ড গিয়ার সবার যৌনতা যেইখানে বিক্রি হইতেছে, সেইখানে এঞ্জেলিনা জোলি বা কঙ্গনা রনৌত বা পরিমণী বা মাহিয়া মীম যৌনতা বিক্রি করলে সমস্যা কোথায়? আর তাতেই উনাদের চরিত্র ‘কলংকিত’ হবে ক্যানো?
এক সময় নারী শুধু শরীরসর্ব্বস্ব ছিলেন। মঙ্গলকাব্যের দেবীদের মতো যৌনতাসর্ব্বস্ব পুরুষের নরম কোমল পুতুপুতু দাস ছিলেন। এরপর নারীবাদী আন্দোলন পরবর্তী পৃথিবীতে নারীরা নিজেদের ‘জ্ঞান’ ‘বুদ্ধি’ ‘প্রজ্ঞা’র প্রমাণ দিতে নিজেদের শরীর ‘ত্যাগ’ করতে শুরু করলেন। উনারা লিপস্টিক ও মেইকাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াইলেন, হাই-হিলের বিরুদ্ধে দাঁড়াইলেন, ক্লিভেজ দেখা যাবে না এমন পোশাক পরলেন, চুল কাইটা ছোট কইরা ফেললেন, সৌন্দর্য্য প্রতিযোগিতার ও সৌন্দর্য্যগরিমা প্রকাশের বিরুদ্ধে কথা কইলেন। উনারা কইলেন, নারী পণ্য না। নারীর বুদ্ধি আছে, যোগ্যতা আছে। সুতরাং নারীশারীরবৃত্তীয় সব কিছু পরিত্যাগযোগ্য।
আমি এই দুই পক্ষেরই বিরুদ্ধে। আমার মাথা এবং শরীর এই দুই নিয়াই আমি নারী। আমার জ্ঞান এবং যৌনতা নিয়াই আমি নারী। আমি এক ত্যাগ কইরা, একরে অস্বীকার কইরা অন্যরে আকড়াইয়া ধরতে রাজি না। আমি নিজের বুদ্ধিতে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বা আবিষ্কারক বা দেশের প্রধানমন্ত্রী বা মহিয়সী নারী হইয়াও আমার যৌনতারে অগ্রাহ্য কইরা, সমস্ত শরীর সম্বন্ধীয় বিলাসিতা ত্যাগ কইরা তারে ঢাইকা রাইখা নিজেরে শুধুমাত্র বুদ্ধিনির্ভর প্রাণী দাবী কইরা পুরুষের সমকক্ষ হইতে রাজি না। আর তাই চরিত্র নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই। আমি একশ’ পুরুষের সাথে শুইয়া, ‘পিন-আপস’ পত্রিকায় স্বল্প পরিসরে বিবৃত হইয়া নিজের শরীর দেখাইয়া, বাংলার মন্দির টেরাকটায় ন্যাংটা হইয়া দ্বিভঙ্গে ব্যাঁকা ব্যাঁকা হইয়া খাড়াইয়া, বঙ্কিমচন্দ্রের নায়িকার মত ‘উরুদেশে মেখলা’ পিন্দা যদি বেশ্যা হই তাতেও আমার আপত্তি নাই, আবার যদি এক স্বামী ব্যতীত কারো সাথে না শুইয়া বা ব্রহ্মচারী হইয়া, সারাজীবন দুই ঠ্যাং গিট্টু দিয়া বইসা জ্ঞানচর্চা করতে করতে মুখে ফেনা তুইলা যদি সতীত্বের ট্যাগ কপালে লাগাইয়া ঘুরি, তাতেও আপত্তি নাই। সতীত্ব বা বেশ্যাত্ব দুইটাই আমার নিজের ইচ্ছাস্বাধীনতার আওতায়। এবং কোনো শব্দেই আমার আপত্তি নাই। কারণ এই দুইয়ের কোনো শব্দই মানুষ হিসাবে বা নারী হিসাবে আমারে মর্যাদাসম্পন্ন বা মর্যাদাহীন করতে সক্ষম না।
আমার শরীরের, আমার যৌনতার দাবীদার একমাত্র আমি এবং আমি এবং আমি; এবং আপনি, আপনার সমাজ, আপনার ধর্ম কেউ এইখানে ‘আর’ খবরদারী ফলাইতে পারবেন না। আমি এই শরীর নিয়া কী করবো, এই শরীর বেঁচবো না ঢাইকা রাখবো, একজনরে দেখাবো না দুই কুড়ি পঁচাত্তরের সাথে বিলাবো তা একান্তই আমার ইচ্ছা। আমার বা আপনার বাপের ইচ্ছা না। তাই এইবেলা আমার এবং আপনার বাপের ইচ্ছারা আমার কাল্পনিক শরীরের চরিত্র ধুইয়া ভিজাইয়া ভিজাইয়া ভিজা মুড়ি খাইতে পারেন। সঙ্গে একটু নারিকেল আর গুড়ও মাখাইয়া নিতে পারেন।
কারণ আমার শরীর বেঁচলেই আমি কলংকিত হই না। কারণ আমার বুদ্ধি বেঁচলেই আমি মহিয়সী হই না। কারণ আপনার মতোই, হে পুরুষ, আমার দুই ঠ্যাঙ্গের মাঝখানে অলিতেগলিতে আমার চরিত্রের সংজ্ঞা লেখা নাই। আর লেখা থাকলেও আমার দুই ঠ্যাং বাইয়া পড়া কামরসে তা সহজেই মুইছা ফেলা যায় হাহা। আগের দিনের চরিত্র নির্ভর ‘আহাউহু’ মেয়েরা উহা জানিতেন না, ইহাই আফসোস!
বিনীত
নাদিয়া ‘ম্যাডোনা এ্যান্ড হোর’ ইসলাম।