খুব সকালে ঘুম ভাঙে। ফোনটি হাতে নিয়ে অভ্যাস বশতঃ সময় দেখি। একবার পত্রিকার সংবাদে চোখ বুলাই। চোখ আটকে যায় একটি সংবাদে। পাশ থেকে বাচ্চাদের বাবা বলে ওঠে, খবর দেখেছো? ছিনতাইকারীদের কবলে একটা বাচ্চা মারা গেছে। সংবাদটি পড়ে শোনায়। আমি কোনো উত্তর দেই না। বলতে ইচ্ছে হয় না, এই সংবাদ দেখেই চুপ হয়ে আছি। গেন্ডারিয়ায় ছিনতাইকারীর হ্যাঁচকা টানে হাত ব্যাগ ছিনিয়ে নেবার সময় মায়ের কোল থেকে পাঁচ মাসের শিশু আরাফাত ছিটকে পড়ে যায়। মাথায় আঘাত লাগায় বাচ্চাটির মৃত্যু হয়। একটি ছোট্ট শিশু পৃথিবীর সকল সুন্দরকে না দেখে শুধুমাত্র কদর্য চেহারা দেখে মারা গেল!
সবচেয়ে হৃদয় বিদারক হলো একটি ভিডিও। শিশু আরাফাতের মা মাথায় হাত দিয়ে রাস্তার পাশে বসে আছেন। কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছে এই দৃশ্য। একটি সমবেদনার হাতও এগিয়ে গিয়ে ভদ্রমহিলার কাঁধে কেউ রাখছে না। এই দেশটার মানুষগুলোর হলো কী! এত সংবেদনহীন সমাজ তো আগে ছিলো না। একজন মানুষের মৃত্যু কি তবে খুব স্বাভাবিক ঘটনা আজকাল! মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা নারীটি একটু আগেও জানতো না কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তার জীবনে। সব সম্ভবের শহর ঢাকায় এসেছিলো বড় সন্তানের চিকিৎসা করাতে, নিদৃষ্ট স্থানে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ছোট সন্তানের মৃত্যু। এই মা কি তাঁর জীবনে আর কখনো স্বাভাবিক হতে পারবে? আর যদি বিচার চাইতে হয় তবে কার বিরুদ্ধে বিচার চাইবে? এই গ্রাম্য নারীকেই জানতে হলো সন্তানের জীবনের বিনিময়ে নিষ্ঠুর সমাজের চিত্রকে! একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামান্য ছিনতাইকারীদের প্রতিহত করার ক্ষমতা নেই, এ ভরসাহীন সমাজে অসহায় আরাফাতের মায়েরা কোথায় যাবে!
এই ঘটনা দেশে নতুন নয় যদিও। এর আগে প্রতিদিন এরকম অগণিত মানুষ ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছেন, আমরা তার কয়টিই বা জানি! খবরগুলো যখন হেডলাইন হয় তখন হয়তো আমরা জানি। এক নববিবাহিতের ছিনতাইয়ের ছবি এবং ঘটনার পরবর্তী বিবরণ ভাইরাল হয়েছিলো। বিসিএস ক্যাডার ডাক্তার মেয়েটির যোগ দেওয়ার কথা ছিলো নতুন কর্মক্ষেত্রে। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে এক ধাক্কায় জীবিত মানুষ জড় পদার্থে পরিণত হয়েছেন। তার স্বামী স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে দিয়ে ভালোবাসার জোরে জীবন্মৃত স্ত্রীর সেবা করে দিন কাটাচ্ছেন। এসব ঘটে যাওয়া ঘটনার কতগুলো আমরা জানি?
খুব কাছের একজন বন্ধুর স্ত্রী ছয়মাসের গর্ভবতী ছিলেন। রিক্সায় যাচ্ছিলেন হাতে ব্যাগটি ধরে রেখেছিলেন। ছিনতাইকারীর টানে ব্যাগসহ পড়ে গেলেন রিক্সা থেকে। ছয়মাসের বাচ্চাটি মিস ক্যারেজ হয়ে গেল এবং ডান পা'টি ভেঙ্গে পড়ে রইলেন বিছানায় কয়েকমাস। এসব ঘটনা পত্রিকায় আসে না বলে আমরা জানতেও পারি না, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি এই দায় এড়াতে পারে?
আরেকটি খবর আজকে এক ধাক্কায় একটি সমাজের চিত্রকে চোখের সামনে এঁকে দেয়। সম্মানিত মেয়র মহিউদ্দিনের মৃত্যুতে চট্টগ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মেয়র হিসেবে তিনি বেশ ভালোভাবেই দায়িত্ব পালন করেছেন এই মর্মে অনেক লেখা চোখে পড়লো। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে ওনাকে চিনি না। তাঁর কুলখানিতে তাঁর ছেলে আশি হাজার মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করে! আর এই কুলখানির খাবার খেতে গিয়েই দশজন মানুষ পায়ের তলায় পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু বরণ করে। এখন একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার মনে হয়, ধর্মীয়ভাবে একজন মানুষের মৃত্যু পরবর্তী কিছু আচার পালনের নিয়ম হয়তো আমাদের দেশে আছে, আর এটা যে যার মতো পালন করতেই পারেন, কিন্তু সেটা পালন করতে গিয়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তার যথাযথ সুব্যবস্থারও দরকার ছিলো। আর খুব সহজভাবে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি দেখতে গেলে, আশিহাজার মানুষকে এভাবে খাওয়ানোর চেয়ে এই অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করলে সেটাই বরং অর্থবহ হতো। এই দশজন মানুষের মৃত্যুর দায় কে নেবে? একটি ব্যক্তিগত কুলখানির দায় কতটুকু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপরে বর্তায়? কিন্তু রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দেখতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায় বোধহয় এড়াতে পারেও না।
এমন কত মৃত্যু প্রতিদিন হচ্ছে! খবরের পাতায় শিরোনাম হয়, আমরা জানি, দু'লাইন লিখে দায় সারি। এ দায়িত্ব কেউ কি আদৌ নেয়? সন্তান হারা মায়ের মুখে কি কখনো হাসি ফোটে ন্যায়বিচার পেয়ে? বিখ্যাত মানুষের কুলখানিতে পায়ের তলায় চাপা পড়ে মৃত্যু আর রাস্তায় ছিনতাইকারীর হাতে অনাকাঙ্খিত মৃত্যু, যোগসূত্রতা কিন্তু একই, 'বিচারহীনতা'। একটি রাষ্ট্রের সাধারণের নির্বিঘ্নে জীবন অতিবাহিত করার মতো একটি সমাজের প্রত্যাশা সেই দেশের মানুষ করতেই পারে, রাষ্ট্রের এই বিষয়ে নজর দেওয়া বোধহয় এখন সময়ের দাবি।।