‘আমি কেন যৌন অপরাধী হলাম আর কেন নারী ধর্ষণে লিপ্ত হলাম’।
ধর্ষণের কথা উঠলেই সচরাচর ধর্ষিতার চরিত্র, তার আচার আচরণ পোষাক পরিধান আলোচনার মূল কেন্দ্রে চলে আসে। অথচ, মূল প্রশ্নটা হওয়া উচিৎ ছিল ধর্ষণকারী কেন ধর্ষণ করে। এর উত্তর দিচ্ছেন একজন দন্ডপ্রাপ্ত যৌন অপরাধী তার জবানবন্দিতে।
একটি ধর্ষণের অপরাধে ও দুটো অশ্লীলতা প্রকাশের অপরাধে আমি দোষী সাব্যস্ত হয়েছি। ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০১ সালে, কিন্তু সত্য বলতে কি স্কুলের সাথী ও প্রতিবেশী মেয়েদের সাথে আমি এই অপরাধ করে ফেলেছি তারও অনেক আগে যখন আমার বয়স ১৫ ছিল। প্রাণের ভয়ে কেউ রিপোর্ট করেনি।এখন আমার বয়স ৪৬। এটা যে একটি অন্যায় গর্হিত কাজ সে ধারণাটাই আমার তখন ছিলনা। মোটেই না। আমি ভাবতাম জগতের যা কিছু সব আমার উপভোগ্য, এতে কারো বাধা দেয়ার অধিকার নেই,কারো নিষেধ করা উচিৎ নয়। সবার আগে আমার অধিকার আমার উপরে কেউ নেই। আমি কারো জন্যে নই সব আমার জন্যে। অবশ্যই এখন আর সেটা মনে করিনা তবে এ উপলব্ধি অর্জন করতে আর পেছনের ভাবনা ও সেই মানসিকতা ত্যাগ করতে আমার জীবনের অনেক মূল্যবান সময় আমি হারিয়ে ফেলেছি। এই মানবিক উপলব্ধি অর্জন করতে আমাকে তিন বছর জেল খাটতে হয়েছে। তারপর একনাগালে ছয় বছরের চিকিৎসা প্রোগ্রাম নেয়ার পর আবার কয়েকদিন কাউন্সেলিং নিতে হয়েছে মানসিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে।
রেইপের জন্যে ৩ বছরের জেল হয়েছিল কিন্তু আমি ১৮ মাস পরেই বের হয়ে আসি। জেল থেকে বের হয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যেই আবার ধরা খাই রাস্তায় অশ্লীলতা প্রদর্শণের (indecent exposure) জন্যে। এই অপরাধে আরো ১ বছরের সাজা হলো। ১ বছর পর বেরিয়ে এসে আবার একই অপরাধে আরো ১ বছর, সব মিলিয়ে সর্বমোট মোট ৩ বছর জেল খেটেছি। এই ৩ বছরে জেলের ভিতর নানা ধর্মের, বর্ণের, বিভিন্ন জাতির লোক, ডাক্তার, শিক্ষক, বিমান পাইলট, চার্চের পাদ্রি কত রকমের মানুষ আমি দেখেছি। এবার ৬ বছর হলো জেল থেকে বেরিয়ে আসার। ছোট শহর Oxfordshire এর ছোট একটি গ্রামে আমি বড় হয়েছি। স্কুলের প্রতি খুব একটা ইন্টারেষ্ট কোনদিনই ছিলনা, স্কুল আমার ভাল লাগতোনা। পাড়ার উসৃংখল বখাটে ছেলেদের একটি দলের সদস্য ছিলাম। ড্রাগ আর এলক্যাহল ছিল আমাদের জীবন সাথী। ১০ হাজার পাউন্ডের নুতন মার্সিডিজ গাড়ির চাকা ছুরি দিয়ে ফুটো করে দেয়ায় কী যে আনন্দ পেতাম। গাড়ির মালিক কী মনে করবে, কতো পাউন্ড লাগবে একটা টায়ার লাগাতে এ সব চিন্তা মাথায় আসতোনা মোটেই। অফিসে যাওয়ার সময় গাড়ির এই অবস্তা দেখে মালিকের মনে কী দুঃখ লাগবে সেটা ভাবতামনা, আমাদের আনন্দ লাগতো ফিস ফিস করে চাকার বাতাস ধীরে ধীরে বের হয়ে গাড়িটা নেতিয়ে যাওয়া দেখতে। দামী গাড়ির সাইড মিরর ভাঙ্গা তো ছিল হাতের কাছে পাওয়া বৃক্ষের ডাল ভাঙ্গার মতো।
অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল তবে কোনোটাই রোমান্টিক ছিল বলবোনা। আমি একটা জিনিষই জানতাম যে, আমার সেক্সের প্রয়োজন, ব্যস মেয়ে একটা হলেই হলো আমি তাকে প্রস্তাব দিতাম। রাজি না হলে জোর চালাতাম। মনে করতাম আমার যেহেতু সেক্স ভাল লাগে মেয়েদেরও ভাল লাগার কথা। মেয়েদের তাড়িয়ে বেড়ানো আমার নেশা ছিল। এক পর্যায়ে পর্ণোগ্রাফি আর সেক্স এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি। তিন বছর জেলের শাস্তি, ছয় বছরের ট্রেইনিং আর দুই বছরের কাউন্সেলিং নেয়ার পর এখন আর সেই নেশা নেই। আমি এখন অনেক পরিণত, ভাল মন্দ যাচাইয়ের ব্যাপারে অনেক সচেতন। কিন্তু সেই যুবক বয়সে, অহ! সব কিছুই এক্সাইটিং সব কিছুই সুন্দর আর আনন্দের মনে হতো। সব চেয়ে ভাল লাগতো নিজের শক্তি প্রদর্শনিতে। আমি যে পুরুষ এটা সকলে জানুক।
আমার ছোটবেলাটা খুব সুখকর ছিলনা। বাবা মায়ের মধ্যে সব সময় ঝগড়া লেগে থাকতো। আমার বখাটে হওয়ার পেছনে তাদের অবদান আছে, তারা আমার কেয়ার মোটেই নিতেন না। আমি কী করি কোথায় যাই তা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা ছিলনা। আমি পাড়ার ছেলেদের সাথে মিলেমিশে তাদের মতো বড় হয়েছি। ২০০১ সালের এক রাতে আমি আমার গার্ল ফ্রেন্ড জুলিকে ধর্ষণ করি। সে আমাকে ড্রাগ ছেড়ে দিতে উপদেশ দিতে থাকে। উপদেশ শুনতে শুনতে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল। তর্কের এক পর্যায়ে সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এক ঘন্টা পরে জুলি যখন ঘরে ফিরে আসে আমি তখন পূর্ণ মাতাল। ঘরে ঢুকার সাথে সাথে আমি তাকে জোর করে সোফার উপর শুইয়ে দেই। সে বাঁধা দিতে থাকে। সে যত জোরাজুরি করতে থাকে আমার হিংস্রতা ততই বাড়তে থাকে। এটা কোনো প্লান করা ঘটনা ছিলনা। আমি আজও বুঝিনা কেন সেদিন আমি এমন করেছিলাম। এখন ধারণা করি একটা কিছু আমার মস্তিষ্কে একটি সিগন্যাল বা নির্দেশকের কাজ করেছিল। না হলে আমি সুস্থ মাথায় আমার গার্ল ফ্রেন্ডকে কেন রেইপ করবো? এর একটি ছিল ড্রাগ ডিলারদের পাওনা বহু টাকার ঋণ আর কিছুদিন যাবত অন্যান্য বিষয়াদি চিন্তা করে আমি নিজেকে বড় অসুখি অভাগা ভাবতেছিলাম। আমি আমার নিজের উপরই সন্তুষ্ট ছিলাম না। যদিও সেই রাতে জুলিকে রেইপ করাতে আমার কোনো প্রকারের দুঃখ বা অনুভুতি ছিলনা। আমি জেল খানায় আসার পর বুঝতে শুরু করলাম জুলিকে আমি কত ভীষণভাবে মিস করছি। আমি নিজের দেহে মনে অনুভব করতে থাকি জুলির শারিরিক মানসিক ব্যথা। অনেক দিন হয় আমি আমার মন থেকে চিন্তা থেকে জুলিকে এক মুহুর্তের জন্যেও সরাতে পারিনি।
সারা রাত সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি জুলি ঘরে নেই। কিছুক্ষণ পরেই দরোজায় নক শুনতে পাই। দরোজা খুলে দেখু পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, পাশেই পুলিশের ভ্যান। এর পরের ঘটনাতো আগেই বললাম। আমি রেইপ কেইসে দোষী সাব্যস্ত হলাম। তিন বছরের জেল হলো। আটারো মাসের পর যখন আমাকে ছেড়ে দেয়া হলো আমার পায়ে ট্যাগ লাগিয়ে আমার উপর কার্ফিউ জারি করে দেয়া হলো। আমার চলাফেরা করার সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হলো। আমি আদালতে সরাসরি স্পষ্টভাবে আমার দোষ স্বীকার করে নিয়েছিলাম।
কারাগারে একটি বিশেষ কক্ষ আমার মতো যৌন অপরাধীদের জন্যে রাখা ছিল। অন্যদের সেখানে প্রবেশের অনুমতি ছিলনা। যৌন অপরাধীরা বিভিন্ন ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসে। দেখলাম অনেকেই বয়ষ্ক এবং শিক্ষিত সমাজ থেকে আসা। খুব কম অপরাধীরাই তাদের অপরাধ নিজে থেকে স্বীকার করেন। বেশীরভাগ লোকেরাই ধর্ষণের জন্যে ভিকটিমকেই দায়ী করেন এই বলে যে নারীই পুরুষকে সেক্স করতে অনুপ্রাণীত করেছিল। কিন্তু আমি জানি আমিই দোষী, সমস্যা আমার মধ্যে ছিল নারীর মধ্যে নয়। কারাগারে এক কক্ষের লোকেরা অন্য কক্ষের লোকের অবস্তা জানতে পারেনা। তবে গ্রুপ থেরাপি দলের লোকেরা একে অন্যের পেছনের কাহিনি জানতে পারে, কারণ এখানে সকলেই সকলের অভিজ্ঞতা ঘটনার প্রেক্ষাপট সহ সব কিছু বর্ণনা করতে হয়। গ্রুপ থেরাপি টিচারের কাছে অনেকেই মিথ্যা বলার চেষ্টা করে কিন্তু টিচাররা এতোই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ যে, শান্ত শিষ্ট আলাপচারিতার মাধ্যমে তারা কোনো না কোনোভাবে সত্যটা অপরাধীর মুখ থেকে বের করেই ছাড়েন। থেরাপি ক্লাসে ইন্টারভিউয়ে অনেককেই বলতে শুনলাম যে, তারা মনে করতেন নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব প্রকৃতি নির্ধারিত, নারী পুরুষের চেয়ে শারিরিক এবং মানসিকভাবেও দূর্বল। আর নারীকে কিচেনেই মানায় ভাল। আমিও ছোটবেলা থেকেই এমনটি মনে করতাম, অবশ্য এটা আমি আমার বাবার কাছ থেকেই শিখেছিলাম।
আমার জেলের শাস্তি, দীর্ঘ দিনের ট্রেইনিং ও কয়েক মাসের কাউন্সেলিং শেষে যখন জেল থেকে মুক্তির দিন ঘনিয়ে আসলো আমার মন চাইলো আমি এখানেই থাকি, এটাই আমার জন্যে নিরাপদ শান্তির জায়গা। সমাজে ফিরে যেতে আমার মন চাইলোনা। আমি বিভ্রান্ত কিংকর্তব্য বিমূঢ়। কী করি, কোথায় যাই, কার কাছে যাই আমি ভেবে কুল পাইনা। আমি কি পারবো নিজেকে কনট্রোল করতে? আমি কি স্বাভাবিক সুস্থ হতে পেরেছি? আমি জানি কোথাও কাজ পেতে হলে এমপ্লয়ারের কাছে আমাকে আমার সব কিছু প্রকাশ করতে হবে। আর স্বাভাবিক পথে বাঁচতে হলে আমাকে কাজ করতেই হবে। আমি আমার নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারণ আমি এখনও জানিনা, বুঝে উঠতে পারিনা, কোন্ সে শক্তি আমার মস্তিষ্কের কোন্ সেই এলিম্যান্ট বা উপাদান যা আমাকে অপরাধে উৎসাহিত করতো? সেটা কি আমার মধ্যে আর নেই? দ্বিধাগ্রস্ত আমি শাস্তিভুক্ত যৌন অপরাধীদের সমাজে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্তাপক ‘সার্ক্যাল’ চিকিৎসা প্রোগ্রামের লোকের সাথে যোগাযোগ করি। এরা একটি অবৈতনিক যৌন অপরাধীদের সাহায্যকারী ভলিন্টিয়ার দল। তারা আমাকে নিশ্চয়তা দিলেন যে, যে কোন প্রকারের সমস্যায় পড়লে আমি যেন তাদেরকে ফোন দেই, তারা ততক্ষণাৎ আমার সাহায্যে চলে আসবেন। জীবনে আমি অনেক ধণী গরিব, শিক্ষিত অশিক্ষিত, ভাল মন্দ মানুষ দেখেছি, কিন্তু এই ভলিন্টিয়ার দলের মতো ফেরেস্তাসম মানুষ আর কোথাও দেখিনি। আমি অবাক হতাম এই ভেবে যে এই মানুষগুলোর এমন কী দায় পড়েছে যে তারা নিজের সময় ব্যয় করে বিনে পয়সায় অন্যকে এ ভাবে সাহায্য করবে? আশচর্য ব্যাপার হলো, আমি একদিন জানতে পারলাম ‘সার্ক্যাল’ এর সদস্যদের অনেকেই এক সময়ের কারাভুক্ত কোনো না কোনোভাবে যৌন অপরাধী ছিলেন। সব শেষে এদের সাথে পরিচয় না হলে, তাদের উপদেশ সাহায্য না পেলে আমি কোনোদিন স্বাভাবিক মানুষ হতে পারতাম কিনা তাতে আমার এখনও সন্দেহ হয়।
মনে মানসিকতায় কিছুটা সেটেল্ড হওয়ার পর একদিন জুলিকে ফোন দিলাম। আমার অন্তরে অনুতাপের আগুন, দ্বিধান্বিত মন, বুকে প্রলয়ের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি, হাত কাঁপছে, কণ্ঠ আড়ষ্ট, অপর প্রান্থ থেকে হ্যালো সুর শোনা যাচ্ছে। আমি হ্যালো বলতে পারছিনা শুধুই ভাবছি, জুলি আমার নাম্বার আজও ডিলিট করেনি?
- হ্যালো ডেভিড, আর ইউ ওকে?
- জুলি, আই জাষ্ট অয়ান্ট টু সে ‘স্যরি’। উড ইউ ফরগিভ মি, প্লিজ?
- ডেভিড, আমি সব কিছু জানি, সব শুনেছি, দোয়া করি তুমি সুখি হও। আমার বিশ্বাস তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।
- থ্যাংক ইউ জুলি, থ্যাংক ইউ, গুড বাই।
আমি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। মানুষের সুখে আমি আনন্দিত হই, মানুষের দুঃখে আমি ব্যথিত হই। আমার মন চায় আমি জীবনে যাদের দুঃখ দিয়েছি, যাদের অনিষ্ট করেছি, যার গাড়ি ভেঙ্গেছি তাদের সকলের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসি। কিন্তু তারা অনেকেই আমার থেকে বহু দূরে অজানা কোথাও চলে গেছেন আর অনেকেই এই পৃথিবীতে আর নেই।
(লেখাটি ২০১৫ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের এক সাংবাদিকের কাছে ডেভিডের (ছদ্মনাম) দেয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে লেখা।)