আকাশ মালিক

ব্লগার ও অনলাইন একটিভিস্ট

ধর্ষণের শাস্তি নিয়ে কিছু কথা

Not enough people understand what rape is, and, until they do ... , not enough will be done to stop it.
—rape victim, quoted in Groth 1979 (p. 87)

শত শত তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ ছোঁড়া হয়েছে, বৃষ্টির মত ঘৃণা বিদ্বেষ বর্ষিত হয়েছে বিগত কয়েকদিন বিরতিহীনভাবে পুরুষ নামের অভাগা মানবপ্রাণীর উপর, তারই গর্ভধারিনী, সহকর্মী, সহধার্মিনী, খেলার সাথী, জীবনসাথী নারীদের পক্ষ থেকে। যেমন;

“বিচারে আমি নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হতে পারি! বিচারের রায় আমার বিপক্ষে যেতে পারে! যা ঘটিয়েছি তা পরিকল্পিত বলে রায় দিতে পারে আদালত! তাই বলে কী এই ভাবনা ভেবে নিজেকে রক্ষার্থে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবো না? অবশ্যই করবো। আমি আমাকে বাঁচাতে দরকারে খুনও করবো। একইভাবে একজন নারী যদি ধর্ষণ থেকে বাঁচতে গিয়ে কারো শিশ্ন কেটে দেয়, আমি বলবো সেটাই তার জন্য একমাত্র উপযুক্ত অবলম্বন, যথার্থ। এর বিরোধীতা যদি কেউ করে, তবে সেও ধর্ষকের সমকক্ষ, নির্দ্বিধায় এ কথাটা বলতে পারি বা তার জন্য এ বাক্যটাই যথাপোযুক্ত”।

“কুকুরেরও ভাদ্র মাস ফুরায়,পুরুষের ফুরায় না”।

“পুরুষ কেবল পুরুষ-ই থাকে,মানুষ হয় না আর কোনদিন”।

“তার নম্র-ভদ্র ব্যবহার, শালীন ভাষা, উচ্চমানের লেখা দেখে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, বেলা শেষে সে যে একজন পুরুষই”।

“ দুই সপ্তাহের মধ্যেই আমার বিরক্তি লাগে, একজন নারী একজন পুরুষের সাথে সারা জীবন ঘর সংসার কেমনে করে”?

“বাংলাদেশে এই মুহুর্তে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চালু আছে তাতে কোনো মেয়েই নিরাপদ না।সে ক্ষেত্রে প্রতিটা মেয়েরই উচিৎ সাথে ব্লেড রাখা”।

এই কথাগুলো আপনারা যখন বলেন তখন কি একটিবারের জন্যেও মনে পড়েনা যে, আপনাদের ঘরেও একজন পুরুষ বাবা, ভাই, স্বামী ছেলে আছেন? এরাও কি শুধুই পুরুষ মানুষ না? এরাও কি ভাদ্র মাসের কুকুর? জানি আপনারা বলবেন যে, সকলকে মিন করা হয়নি তবু এমন জেন্যারালাইজড কথাগুলো কিছুটা হলেও আপনার পাশের পুরুষটিকে যে বিভ্রান্ত করে তুলেছে তা কি টের পান?

 

তর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা লিঙ্গকর্তন বিরোধী তিনজনের তিনটি লেখাই আমি মনযোগ দিয়ে পড়েছি। তাদের লেখাগুলো পড়ে আমার মনে হয়নি তারা কেউই নারীবিদ্বেষী, ধর্ষকের সমর্থক, কিংবা ‘শিশ্ন বাঁচাও পুরুষ বাঁচাও’ আন্দোলনকারী, অথবা আপনাদের ভাষায় ‘শুধুই পুরুষ, মানুষ না’। আমার মনে হয়েছে তারা বরং ধর্ষীতা নারী যেন একটি মারাত্বক দৈহিক মানসিক আঘাত (trauma) থেকে উঠে এসে আরেকটি বিপদের দিকে পা না বাড়ান সেই লক্ষ্যে তারা আইনী ও সামাজিক দিক এবং ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তার উপর আলোকপাত করেছেন। একজন শিক্ষিত সচেতন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কোনো সময়ই ধর্ষকের সমর্থক হতে পারেন না। যারা ধর্ষণ করে তারা বিকৃত মস্তিষ্কের, তারা অসুস্থ। নারীর যেমন একজন পুরুষ বাবা আছেন, ভাই আছে, স্বামী আছে ছেলে আছে, পুরুষেরও একজন নারী মা আছে বোন আছে মেয়ে আছে স্ত্রী আছে। সচেতন নারী-পুরুষ কেউই কোনো অবস্তাতেই ধর্ষণ সমর্থন করেন না। একজন ধর্ষিতার মনোকষ্ট একজন নারী যতটুকু অনুভব করেন একজন পুরুষও ততটুকুই করেন। ধর্ষণ বন্ধের উপায় ও ধর্ষকের শাস্তি নিয়ে ভিন্ন মত ভিন্ন পথ থাকতে পারে।

ক্ষোভ-রাগ, দুঃখ-ক্লেশ, ঘৃণা-বিদ্বেষ, এমন পর্যায়ে এসে পৌছেছে যে, বাকি আছে শুধু শুনার, ‘ পৃথিবীটা পুরুষহীন হয়ে গেলেই বাঁচি’। জন্মে তো আমাদের হাত নেই দিদিগন। নিজের ইচ্ছেশক্তি প্রয়োগ করতে পারলে হয়তো নারী হয়েই জন্ম নিতাম। আমাকে শুধু পুরুষ করেই ছেড়ে দেয়া হয়নি কিছু বেসিক ইন্সটিঙ্কট (সহজাত প্রবৃত্তি) ইনপুট করে দেয়া হয়েছে আমার মস্তিষ্কেও। এটা আপনার মধ্যেও আছে, আছে সারা পৃথিবীর প্রাণীদের মধ্যেও। তবে এই ইন্সটিঙ্কট কতোটা বায়োলজিক্যাল, কতোটা nature আর কতোটা nurture সেটা আলোচনার দাবী রাখে। শুনেছি বিছানায় স্ত্রী তার স্বামীর বন্য আচরণ চোখ বুজে খুব উপভোগ করে আর পুরুষটি স্ত্রীর সমস্ত শরীর চোখ দিয়ে ভক্ষণ করে। এই ইন্সটিঙ্কট বলতে ‘ধর্ষণ পুরুষের সহজাত প্রবৃত্তি’ বোঝানো হয়নি। তবে অন্য কিছু প্রাণীর বেলায় কথাটা সত্য।

আমি অবাক হয়েছি এতো শত কথা বলা হলো কিন্তু কেউ এই জঘন্য অমানবিক ধর্ষণের কারণ নিরুপন বা ব্যাখ্যাটা জীববিজ্ঞান, বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের আলোকে করার চেষ্টা করলেন না। যেখান থেকে সমস্যার উত্থান সেখানেই তার পতনের পন্থা খুঁজতে হবে, ঠিক না? ধর্ষণের ইতিহাস তো অনেক পুরনো, এটা সারা পৃথিবীর মানব জাতির সমস্যা। হুট করে বলে দিলেন, সকল মেয়ের ভ্যানিটি ব্যাগে একটি করে ব্লেড রাখা চাই, অবস্তা খারাপ দেখলেই ঘ্যচাং। ব্যস, দুই তিনটা ধর্ষকের লিংগ কেটে দিলেই ধর্ষণ কমে আসবে? এক দুজন ধর্ষিতা হয়তো লিঙ্গ কাটার সুযোগ পেয়েছিলেন পরের বার ধর্ষক আর সেই সুযোগ দিবেনা। আপনার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ব্লেড বের করার আগেই ধর্ষকের ট্রাউজারের পকেট থেকে ছুরি বের হয়ে আসবে। ব্লেডের চেয়ে ছুরি ব্যবহার করা সহজ। ব্লেড ব্যাগে থাকতে থাকতে ভুল বুঝে একদিন ভুল মানুষের উপর প্রয়োগ হয়ে যেতেও পারে। আমেরিকার পাবলিকের হাতে পিস্তল এর উজ্জল দৃষ্টান্ত।

সেক্সুয়েল ভায়োলেন্স, সেক্সুয়েল হ্যারাসমেন্ট, রেইপ, এটেম্পট টু রেইপ এরও প্রকারভেদ আছে, আছে মোটিভেশন ইনটেনশন, একশনের ব্যাপার। আপনি ঠিক কোন মুহুর্তে বুঝবেন যে লোকটি আপনাকে ধর্ষণ করতে নাকি খুন করতে ইচ্ছে করেছে? ঠিক কোন সময়ে আপনি বুঝবেন যে এবার ভ্যানিটি ব্যাগে হাত ঢুকাবার সময় এসেছে? যদি আপনার সাধুশন্ত সুন্দর চেহারার যুবক ভাইটির প্রেমে মাতাল, অফিসের সহকর্মী মহিলা কোনো এক নির্জন মুহুর্তে হিংসার বশবর্তি হয়ে প্রতিশোধ নিতে বিচ্ছিরি কিছু ঘটিয়ে এটেম টু রেইপের কেইস করে বসে, আপনি কি সেখানেও আপনার সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন? জুলেখা কিন্তু ইউসুফের উপর রেইপের কেইসই করেছিল, একদম জামাকাপড় টুকরো টুকরো করে। সেদিন ডি এন এ টেষ্ট করলে জুলেখার গায়ে ইউসুফের হাতের দাগ পাওয়া যেতো। হয়তো ইউসুফের জামায় জুলেখার এক দুটো চুলও লেগে থাকতে দেখা যেতো। জুলেখার হাতে সেদিন ব্লেড থাকলে ইউসুফকে নিশ্চিত না পাওয়ার ক্ষোভে তার লিঙ্গ কেটে দিত। একজন প্রেমিকা তার মনের পুরুষটিকে না পাওয়ার দুঃখে এমন কাজ করতেই পারে। স্ত্রী বড় অংকের ইনস্যুরেন্সের টাকা মেরে দিতে বা পরকিয়ার কারণে নিজ স্বামীর উপর রেইপ কেইস করে দিতে পারে তার জন্যে রেইপ প্রমাণ করা অনেক সহজ। আপনি কি বিনা দোষেই একজন পুরুষের লিঙ্গ কেটে ফেলার হুকুম দিবেন? এমন ঘটনা কিন্তু ঘটেছে। মাদকাসক্ত স্বামীর লিঙ্গ কেটে ঘর থেকে চিরতরে বের করে দেয়া স্ত্রীর জন্যে খুবই সহজ। অথচ লোকটি হয়তো আসক্তি ত্যাগ করে একদিন সুস্থ জীবনে ফিরে আসতেও পারতো। এ রকম হাজার হাজার ঘটনা রিসার্চ করে বিশ্লেষণ করে গবেষণা করে অনুসন্ধান চালিয়ে উন্নত দেশগুলোতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ধর্ষকের শাস্তি শিশ্ন কেটে ফেলা হতে পারেনা।

বিগত মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে শুধু আমাদের এলাকায় মোট ৬ জন বাঙ্গালী মুসলমানের ৭ থেকে ১৩ বছরের জেল হলো ধর্ষণ সংক্রান্ত কেইসে। মুসলমান উল্লেখ করলাম এই জন্যেই যে, এদের ৬ জনেরই মুখে দাড়ি আছে, সকলই নিয়মিত অন্তত জুম্মার নামাজী আর সকলেই বিবাহিত ৩ থেকে ৮ সন্তানের পিতা। ৫ জন ফিজিক্যালি ধর্ষণ না করেই কারাগারে শাস্তি ভোগ করছেন আর যিনি সত্যি শারিরিক ধর্ষণ করে ১৩ বছরের জেল খাটছেন তিনি নিজে অভাগিণী স্ত্রীর স্বামী। স্বামী কর্তৃক স্ত্রী ধর্ষণের কেইস পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী ইংল্যান্ডে এটাই প্রথম। সেদিক থেকে বাঙ্গালী মুসলমান একটি ইতিহাস রেকর্ড করলো। ব্রাডফোর্ডের পাকিস্তানী ধর্ষক গ্রুপের লোমহর্ষক কাহিনী সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়েছিল। সঙ্গত কারণেই এখানে এলাকার নাম সময় তারিখ উল্লেখ করা গেলনা, তবে সবগুলো ঘটনাই স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত আছে। শাস্তি হয়েছে সকলেরই আইন অনুযায়ী কারো লিঙ্গ কর্তন করা হয় নি।


প্রত্যেকটা ঘটনার পেছনে কারণ থাকতে বাধ্য। সেই কারণটা খুঁজতে হবে। ধর্ষণের সময়ে ধর্ষকের মনস্তাত্তিক অবস্থাটা কেমন হয়, কেন হয় জানতে হবে। সমাধান পেতে হলে সমস্যার শেকড় সন্ধান করতে হবে, প্রশ্ন করতে হবে। পৃথিবীর সকল দেশেই নারী আছে পুরুষ আছে। সকল দেশে সকল জায়গায় সকল পরিবেশে সকল সমাজে, সকল সময়ে সমানভাবে ধর্ষণ হয়না। কেন? তাইলে বুঝা গেল এর সাথে সামাজিক রাষ্ট্রিক পরিবেশিক, রাজনৈ্তিক অর্থনৈতিক, সরকার, প্রশাসন, শিক্ষা সংস্কৃতি জড়িত। ব্লেড যদি চালাতে হয় ওদিকে চালান। ক্ষণস্থায়ী আপাতঃ সমাধান নয় চিরস্থায়ী সমাধান আমাদের সকলের কাম্য। নারী পুরুষ আমরা সকলেই সকলের মঙ্গলার্থে, আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্যে একটি ধর্ষকমুক্ত পৃথিবী চাই।

এ বিষয়ে আরো জানতে ইচ্ছুক আপনারা নিচের বইটি একবার পড়ে নিতে পারেন।

A Natural History of Rape
Biological Bases of Sexual Coercion
By RANDY THORNHILL and CRAIG T. PALMER

3131 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।