যে সকল বঙ্গনারী ইন্টারনেটে এসে লেখনীর মাধ্যমে সারা দুনিয়ার সামনে বুক ফুলিয়ে গর্বিত কণ্ঠে ঘোষণা দেন কিংবা প্রচার করেন; ‘আমি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী,আমি নামাজী,আমি হিজাবী আর একই সাথে আমি নারীবাদীও’ তারা আপাদমস্তক নির্বোধ আর অন্তরে বাহিরে ভন্ড। এক গাদা বস্ত্র জড় করে মাথার উপরে ঘুঘু পাখির বাসা আর হুতুম পেঁচার চেহারা বানিয়ে আপনি যদি বলেন এটা আপনার পছন্দের বসন তাইলে আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনি কারো নির্দেশ মান্য করতে কাউকে খুশী করতে আর কাউকে ধোঁকা দিতে এ কাজটি করছেন, নিজের ইচ্ছেয় নিজের জন্যে মোটেই নয়। বুকে হাত দিয়ে সত্যি বলুন তো বোনেরা আমি কি মিথ্যে কিছু বললাম? দাসত্বের নিদর্শন মাথায় বহন করে যদি বলেন ‘আমি নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী’ তাইলে ক্যামনে কী দিদিগণ?
আচ্ছা, আপনার আমার মা-খালা, মামী-চাচী, দাদী-নানী তারা যে শাড়ীর আঁচলে অর্ধেক মাথা ঢাকা জীবন কাটিয়ে গেলেন তারা কি বড্ড খারাপ, খুব অশুদ্ধ মুসলমান ছিলেন? দিন তারিখ মনে আছে কবে থেকে, কোথা হতে হিজাব নামের এই ঢঙ্গের শুরু? বিড়ালের কণ্ঠে যে উদ্দেশ্যে ঘণ্টি বাঁধা হয়, আগেকার দিনে নারীর পায়ে পুরুষ সেই উদ্দেশ্যে মল বেঁধে দিত। নারী মনে করতো, আহা কি সুন্দর বাজে। আপনার মাথার হিজাব পুরুষের অধীনস্ত অবরোধবাসীনীর প্রতীক। আপনি পুরুষতন্ত্রের বিরোধী, এ কথা আপনার মুখে মানায় না। আপনি কেন এর পক্ষে অবস্থান নেন, নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া অনেক অনেক বছর পূর্বে তা বলে দিয়েছেন। বেগম রোকেয়া লিখেছেন; “আমরা বহু কাল হইতে অবরোধ থাকিয়া থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের-বিশেষতঃ আমার কিছুই নাই। মেছোণীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, “পচা মাছের দুর্গন্ধ ভাল না মন্দ?”-সে কি উত্তর দিবে? বিবাহিতা নারীগণও বাজীকর-ভানুমতী ইত্যাদি তামাসাওয়ালী স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে পর্দ্দা করিয়া থাকেন। যিনি যত বেশী পর্দ্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশী পেঁচকের মত লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশী শরীফ”।
যে ধর্ম আপনাকে এতো অপমান করলো, আপনার অধিকার কেড়ে নিল, আপনাকে দমন পীড়নের সকল ব্যবস্থা করলো, আর আপনি কিনা সেই ধর্মের জয়গান গান? জানেন বেগম রোকেয়া কী লিখে গেছেন? বলেছেন “যখনই কোন ভগ্নি মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন তখনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।...এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নতমস্তকে নরের অযথা প্রভূত্ব সহা উচিৎ নহে। আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ় সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।...কেহ বলিতে পারেন যে, ‘তুমি সামাজিক কথা কহিতে গিয়া ধর্ম লইয়া টানাটানি কর কেন?’ তদুত্তরে বলিতে হইবে যে, ‘ধর্ম’শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমনীর উপর প্রভূত্ব করিতেছেন। তাই ‘ধর্ম’ লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম।’(রোকেয়া, কাদির, ১৯৭৩, পৃ. ১১-১৩)
আপনার মাথায় পাখির বাসা হিজাব দেখলে আমার মনে পড়ে যায় বেগম রোকেয়ার সেই কথাগুলো;
“আমাদের অতিপ্রিয় অলঙ্কারগুলি- এগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ। ...কারাগারে বন্দীগণ পায়ে লৌহনির্মিত বেড়ি পরে, আমরা স্বর্ণরৌপ্যের বেড়ি অর্থাৎ ‘মল’ পরি। উহাদের হাত-কড়ি, লৌহ-নির্মিত, আমাদের হাতকড়ি স্বর্ণ বা রৌপ্য-নির্মিত চুড়ি। কুকুরের গলে যে গলবন্ধ (dog-collar) দেখি উহারই অনুকরণে বোধ হয় আমাদের জড়োয়া চিক নির্মিত হইয়াছে। ...গো-স্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয়া ‘নাকাদড়ি’ পরায়, এদেশে আমাদের স্বামী আমাদের ‘নোলক’ পরাইয়াছেন!! ঐ ‘নোলক’ হইতেছে ‘স্বামীর’ অস্তিত্বের (সধবার) নিদর্শন”।
আপনার হিজাবও পুরুষের অধিনস্ততার নিদর্শন। এই যুগে এসে একজন শিক্ষিত নারী যিনি নিজেকে নারীবাদী বলে দাবী করেন তিনি হিজাবকে তার ইচ্ছে বসন বলে প্রচার করবেন তা ভাবতেও অবাক লাগে। নাহ, আপনার ইচ্ছের উপর আমার কোনো কথা বলার অধিকার নেই। যে কোনো সাজে যে কোনো রঙ্গে যে ভাবে আপনার মন চায় আপনি সাজতে পারেন কারো কিছু বলার থাকতে পারেনা। কিন্তু যে জিনিসটা অন্যের চিন্তায় গড়া, অন্যের স্বার্থে করছেন সেটাকে নিজের পছন্দের বললে কিছু কথা আমাদেরকেও বলতে হয়। কারণ আপনার পছন্দ সমাজে প্রভাব ফেলতে পারে খুব ধ্রুতভাবে। আপনি একই সাথে একজন সংস্কারবাদী, নারীবাদী, নারী স্বাধীনতার আন্দোলনকারী আবার ধর্মপ্রচারকারীও হতে পারেন না। শেষ করছি কবি নজরুলের সাম্যের গান ‘নারী’ কবিতার কিছু কথা দিয়ে;
“স্বর্ণ রৌপ্য অলঙ্কারে যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী বলো,কোন্ সে অত্যাচারী।
চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না হাতে রুলি পায়ে মল,
মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও শিকল।
যে ঘোমটা তোমা করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন যেথা যত আভরণ”।