আজ এখন ২০১৩'র জুন মাসের ঢিলেঢালা উষ্ণ বিকেল বেলা। বিকেল ৪টা'র মতো হবে। আমার ছেলেটা আজ দুদিন ধরে ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত, আজ তার অবস্থা খুবই খারাপ। হু হু করে জ্বর বেড়ে চলেছে। হঠাৎ আমাকে ডেকে বলছে 'মা আমি আর পারছি না আমাকে হাসপাতালে নাও, শিগগির কর।' তাকে নিয়ে হাসপাতাল ইমার্জেন্সিতে যাবো বলে দ্রুত রেডি হচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি, হাসপাতালে গেলেও ডাক্তার দেখানো ও চিকিৎসা পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যাবে। জ্বরে বেহুশ থাকায় আজ দু’দিন ধরে সে কিছুই খাচ্ছে না। তাকে একটু কিছু না খাইয়ে কেমন করে যাই!
তাড়াহুড়া করে ফ্রিজার থেকে চিকেন বের করে একটা স্যুপ তৈরি করছি। চুলার উপরে স্যুপের ডেকচি, স্যুপ রেডি হয়েছে। কাচের বাটিতে ঢেলে নিয়ে ঝড়ের গতিতে যেই না পা বাড়িয়েছি ওমনি চিকেন কাটার জন্য মেঝেতে পাতা বটিতে সাই করে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলো ডান পায়ের কনে আঙ্গুল।
চোখের নিমেষে এতো রক্ত, রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে সারা কিচেন ফ্লোর। কিছুতেই তা সামলাতে পারছি না। হঠাৎ কেমন একা হয়ে গেলাম। ছেলে ওঘরে কাৎরাচ্ছে। আমি কিচেনে পা কেটে স্তব্ধ বোবা শূন্যতায় মেঝেতে বসে শক্ত হাতে পা চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছি। আমার চারিদিক জুড়ে রক্ত! ডান হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝপ ঝপ করে রক্ত পড়ছে।
এত রক্ত দেখে আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। হাত সরিয়ে উঠেও দাঁড়াতে পারছি না। কিছু একটা দিয়ে বাঁধা দরকার, হাতের কাছে কিছুই নেই। হামাগুড়ি দিয়ে কিচেন ছেড়ে ক্লজেটের কাছে এসে হাতাহাতি করে একটা ওড়না পেলাম। সেটা ছিড়ে টাইট করে বেঁধে উঠে দাঁড়ালাম। ফোন হাতে ট্যাক্সি ডেকেছি, ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বিছানা থেকে তুলে চামচ ভরে স্যুপ তুলে তুলে মুখে দিয়েছি। একটু খেয়েই হাত দিয়ে বাটি ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। এবার তাকে ধরে নিয়ে ঘর থেকে বেরুচ্ছি আর পিছনে তাকিয়ে দেখছি আমার সারা ঘরের মেঝেতে আতঙ্কিত হবার মতো দৃশ্য।
ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের অফিসে যখন পৌঁছলাম তখন বাজে প্রায় ছ'টা। ট্যাক্সি থেকে নামার সময় দেখি পা রাখার জায়গাটা ছোপছোপ রক্তে ভরা। টাকা মিটিয়ে দিয়ে মেডিকেল সেন্টারে যখন ঢুকলাম তখন কেবল মাত্র জরুরি বিভাগ খোলা। আমার ডাক্তার চলে গেছে। নার্স এসে পায়ের কাটার গভীরতা দেখে, সেলাই করতে হবে বলে সাথে সাথে এম্বুলেন্স ডেকে আমাকে পাঠালেন ফরেস্ট হিলস নর্থসোর ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। ছেলে রইল এল্মহার্স্টের ডাক্তারের অফিসে। সে জ্বরে কাতর, দাঁড়াতেও পারছে না। প্রচন্ড রক্তক্ষরণে আমারো মাথা ঠিক মতো কাজ করছে না। তাকে ওখানে রেখেই আমি চলে গেলাম। মা সাথে আছে বলে সে ঘরের চাবি নেয় নি সাথে। তার হাতে টাকা দিয়ে আসতেও ভুলে গেলাম। সে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, জ্বরে বেহুশ বসে রইল ডাক্তারের আশায়। কখন তার ডাক পড়ে!
ওদিকে আমি নর্থ সোর হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে বসে আছি। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে এই বসে থাকা। ইস্যুরেন্স রেকর্ড নিয়ে, ওজন, ব্লাড প্রেশার, জ্বর- টর চেক করে বসিয়ে রেখেছে। আরো কিছুক্ষন পরে ডাক পড়লো ডাক্তারের রূমে। ভালো করে সব দেখে টেখে দু'জন মহিলা ডাক্তার মিলে সেলাই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, চিত হয়ে শুয়ে আছি টেবিলের প'রে। হঠাৎ কানের কাছে ছেলের ফোন বেজে উঠলো। সে চিৎকার করে কান্না শুরু করলো। ডাক্তার তাকে দেখে ওষুধ লিখে দিয়েছে কিন্তু তার ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। তার কাছে ঘরের চাবি নেই, বাসায় যাবার মত ট্যাক্সি বা ট্রেন ফেয়ার নেই, সে দাঁড়াতে পারছে না সোজা হয়ে, তার মাথা ঘুরছে সে কেমন করে বাসায় যাবে! আর্তনাদ করে কাঁদছে আমার সিদ্ধার্থ। 'ওরে আম্মুরে কেনো তুমি আমারে আনলা' আমি এইখানেই মরে যাচ্ছি রে! আমার কাছে টাকা নেই, ঘরের চাবি নেই, আমি মরে যাচ্ছি রে আম্মু! আমি বাসায় যেতে চাই, আমার ওষুধ লাগবে না!'
এদিকে আমার সামনে সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে টিটেনাস ইঞ্জেকশন রেডী করছেন ডাক্তার। এক্টিসেপ্টিক তুলা দিয়ে জায়গাটা মুছে নেয়া হয়েছে। ইঞ্জেকশান এগিয়ে আসছে! আমি ধড়ফড় করে উঠে বসে ডাক্তারকে বললাম আমার এমার্জেন্সির কথা। বলতে বলতেই রক্ত জমাট পা টানতে টানতে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম! যে ট্যাক্সি দেখি ছুটে গিয়ে তাতেই উঠতে গিয়ে দেখি প্যাসেঞ্জার বসা। আবার একটা দেখে অন্যদিকে পা টেনে টেনে দৌড়াই। টেনশানে আমার বুক ধড়ফড় করছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, সময় যেন ফাঁসির দড়ির মতো ঝুলছে আমার সামনে। শেষমেশ খালি ট্যাক্সি একটা পেয়ে ঝাপয়ে গিয়ে উঠলাম। পায়ের ব্যথা ট্যথা কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
সিদ্ধার্থকে দেখি মেডিকেল সেন্টারের সামনে বড় রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে সাই সাই করে সব গাড়ী চলে যাচ্ছে তার ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। ওকে তুলে বাসায় ফেরার পথে রাইট এইড ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে বাসায় ঢুকলাম। ট্যাক্সি বসিয়ে রেখেছি বাসার সামনে উপায় নেই। একটু স্যুপ আবার তাকে খাইয়ে নিয়ে ওষুধ দিলাম। তার হাতের কাছে পানির বোতল আর ফোন গুছিয়ে দিয়ে দৌড়ে বের হলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার ফিরলাম সেই ডাক্তারের সামনে।
প্রায় আধা ঘন্টা প্রস্তুতি আর আধা ঘন্টা সেলাই বাকী সময় ধাপে ধাপে অপেক্ষা, রাত প্রায় বারোটা বাজে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সুনসান রাস্তায় একা হাঁটছি। ব্যান্ডেজ বাঁধা পা আর টেনে তুলতে পারছি না। বড় রাস্তার মোড়ে এসে ট্যাক্সি কল করে দাঁড়িয়ে রয়েছি একা। আজ কোন তিথি! চাঁদের আলো এত কুয়াশা মাখা কেনো! মনে হচ্ছে এ যেন সত্যি নয়, আমি কোনো ছবিতে বা নাটকে কাজ করছি যার দৃশ্যগুলো এখন ধারণ করা হচ্ছে একটি করুণ ধূসর সেলুলয়েডের ফিতেয়।
ট্যাক্সি থামিয়ে ফেরার পথে ওয়ালগ্রীন ফার্মেসি থেকে ব্যথার ওষুধ আর এন্টিবায়োটিক নিয়ে এই মাত্র ঘরে ফিরলাম, এখন পায়ের এনেস্থেসিয়া কেটে যাচ্ছে আর শুরু হচ্ছে যন্ত্রনা। সাভারের ভেঙ্গে পড়া গার্মেন্টস শ্রমিকদের কথা ভেবে আমার এই পুরো জার্নিটা সহজ হয়ে এলো। সেই সব নারীর জীবনের যুদ্ধ আর বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি আমাকে উদ্দীপ্ত করলো। আমি শত ঝড় ঝঞ্ঝার ভেতরেও অনুভব করলাম, জীবনই মোক্ষম। জীবনই আসল। জীবনই সকল সৃষ্টির উৎসব। মৃত্যুই হলো জীবনের সমূহ ক্ষতি। মৃত্যু নয় তবে, জীবনের জয়গান হোক।