‘তুমি আর দশজন মায়ের মতো সংসার করো না, আলাদা থাকো, এটার জন্য আমার বিয়েতে সংকট তৈরি হবে। আমার জীবন কেনো তোমার জন্য সমস্যায় পড়বে?’- সন্তানের এমন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় মাকেই। এই সন্তানরা যতই শিক্ষিত হোক আর আধুনিক হোক মায়ের বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করার দায় অধিকাংশই মেনে নেয় না। অথচ একদিন সেই সন্তানের জন্য মা এমন নরকবাসকে নিয়তি বলে মেনে নিয়েছিলো। নিজের সুখের কথা বিবেচনা করে সন্তানদের কষ্ট দেয় নি।সংসারে যখন দুটি মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থাকে না তখন সংসার টিকিয়ে রাখার মানে গ্যাংগ্রীন নিয়ে বেঁচে থাকা। যে গ্যাংগ্রীন একদন্ডও শান্তিতে থাকতে দেয় না, ঘুমাতে দেয় না। গ্যাংগ্রীনকে সাথি করে বাঁচার মতো কষ্টকর পরিস্থিতি আর নেই। তবুও এই গ্যাংগ্রীন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কেউ কেউ বাধ্য হয় সন্তানের স্বার্থে, পরিবারের ও সমাজের চাপে। সংসার ভাঙ্গার মতো হিম্মতও অনেক নারীর থাকে না। তখন সে গ্যাংগ্রীন সম্পর্কের সাথে নরকবাস করে চলে।
মা-বাবা বা আত্মীয় পরিজনরা যে কোনো পরিস্থিতিতেই মেয়েকে বাধ্য করে সংসারে পড়ে থাকতে। তারা নিশ্চিত জানে সে সংসারে মেয়ের সুখ নেই। তবুও তারা সেখানেই রাখতে চায়। সমাজের দোহাই দিয়ে, সম্মানের দোহাই দিয়ে মেয়েকে এক নারকীয় জীবনের দিকে ঠেলে দেয়। সমাজও নারীর বিচ্ছেদ জীবনকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারে না। স্বামীর ঘর থেকে ফেরা কোনো নারী যে সব সময় নিজের দোষে ফেরে না একথা মানতে পারে না এই দানব সমাজ। আত্মীয় স্বজনরাও চায় মেয়ে যেন বিচ্ছেদ জীবনে না যায়। আর যদি সন্তান থাকে তো কোনো কথাই নেই। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে সংসারে পড়ে থাকতেই হবে এমন আরোপিত জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হয়। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয় এমন নারীর জীবন আরো ভয়াবহ। বিচ্ছেদ হলে সম্মানের দোহাই দিয়ে কোনো কোনো বাবা-মাও মুখ ফিরে নেয়। ফিরে যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না বলে নারীটি কোনো উপায় খুঁজে পায় না। কখনও মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের বিরূপতায় আত্মহত্যার মতো পথও বেছে নেয় নারীটি। সন্তান জন্মের আগেই বিচ্ছেদে যাওয়া নারী অবশ্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একা পথ মাড়াতে পারে। তাতেও তাকে কম কলঙ্ক সইতে হয় না। কিন্তু সন্তান থাকলে সে উপায় থাকে না। সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নিজের সুখের বা স্বস্তির কোনো জীবন খুঁজতে পারে না। নিজের নুন্যতম আত্মসম্মানবোধ শ্রদ্ধা-ভালবাসাহীন ঘরের বাইরে ঠেলে দেয় তাকে। কিন্তু সন্তানদের সুখ ও নিরাপত্তার বিবেচনা করে নিজের সুখ বিসর্জন দেয় নারীটি। কখনও আত্মীয় পরিজন ও সমাজের সামনে সংসারের ভান করে যাপন করে এক বিচ্ছিন্ন জীবন।
মা-বাবার জীবন সুখের না হলে সন্তানদের শৈশব কঠিন সংকটে পড়ে নিঃসন্দেহে। বিচ্ছিন্ন সংসারের সন্তানদেরও অনেক সংকট নিয়ে বেড়ে উঠতে হয়। এই বিষয়গুলোর দায় কি শুধুই মাকে আপোষ করতে হবে? অন্যরা না বুঝুক, সন্তানরাও বুঝবে না!এমন মায়ের সন্তান বড় হয়েও কোনো ছাড় দেয় না মাকে। তারা দাবি করে বসে নিষ্ঠুর সামাজিক দাবীগুলোর মতো। কেনো তুমি অন্য দশ জনের মতো সংসার করতে পারো নি, এটা তোমার ব্যর্থতা! তুমি কেনো অন্যদের মতো মা নও, যার দায় আমাদের জীবনে প্রতিফলন হবে! আমাদের নিজের সংসারে কেনো তোমাকে নিয়ে কথা শুনতে হবে! এমন হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় মাকে। অথচ সবকিছুর মূলে থাকা বাবাকে কখনই কেউ প্রশ্ন করে না। সমাজ বা পরিবারের মতো আপন সন্তানও বাবাকে দায় দিতে চায় না।
প্রশ্ন হলো কেনো সন্তানরা দাবী করে তাদের মাকে অন্য দশজন মায়ের মতো হতে হবে? কেনো সন্তানরা বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারে না? তাহলে কি তারা একটা শ্রদ্ধাহীন, ভালোবাসাহীন সম্পর্ককে মেনে নিতে মা-বাবাকে বাধ্য করতে চায় না? কেনো তারা দাবী করে বিয়ে করলে টিকিয়ে থাকতেই হবে?
সন্তান বড় হলে তারাও অভিভাবক হয়ে উঠতে পারে মায়ের। সারাজীবন মা যে কষ্ট-যন্ত্রণা পেয়ে সন্তানদের বড় করেছে তার জন্য কি কোনো দায় জন্মায় না সন্তানের?