একাত্তর সালের ২৫ মার্চের গণহত্যা ছিলো পাক বাহিনী কতৃক বাঙালী নিধনের জঘন্যতম সূচনামাত্র। পরবর্তী নয়মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৩০ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সৃষ্টি করেছিলো সেই বর্বর ইতিহাস, যা নিষ্ঠুরতা এবং এবং সংখ্যার দিক দিয়ে ইহুদি নিধনযজ্ঞ (হলোকাস্ট) বা রুয়ান্ডার গণহত্যাকেও অতিক্রম করে গেছে।
পাক হানাদার বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হতো না এত অল্প সময়ে এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো যদি না এদেশীয় বেঈমান, স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক দালালরা তাদের সাথে যোগ দিতো। যে সমস্ত ঘৃণ্য দালাল পাকিস্তানিদের পক্ষে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে শর্ষিণার প্রভাবশালী পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ অন্যতম।
নরঘাতক টিক্কা খানের আমলে ঢাকার ফরাসগঞ্জের লালকুঠিতে যে সকল পীর, মাদ্রাসার মোদাররেস, ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক রাজাকার বাহিনী গঠন, প্রতিটি মাদ্রাসাকে রাজাকার ক্যাম্পে পরিণত করা এবং সকল মাদ্রাসা ছাত্রকে রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় শর্ষিণার পীর তাদের অন্যতম। শর্ষিণার পীরের 'দাওয়াতে' হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস জুড়ে বরিশালের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং অগ্নিসংযোগ ও লুট করে। পীরের নির্দেশে শর্ষিণা মাদ্রাসার ৫ শতাধিক তালেবে এলেম প্রায় ৩০ টি গ্রামে হামলা চালায় এবং বাড়ী ঘর ও বাজার লুট করে কয়েক কোটি টাকার সোনা, খাদ্যদ্রব্য, আসবাবপত্র, ও নগদ অর্থ এনে পীরের 'বায়তুল মালে' জামানত হিসেবে জমা করে।
পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ হিন্দুদের সম্পত্তি এমনকি হিন্দু নারীদেরকেও 'মালে গনিমত' হিসেবে ফতোয়া দেয়। তার নির্দেশে তালেবে এলেম রাজাকাররা হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল আটঘর, কুড়িয়ানা ও ধলারে পাঁচ দিক থেকে একযোগে হামলা চালিয়ে কাফের আখ্যা দিয়ে হাজার হাজার পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে হত্যা করে। হামলার পর সেখানে বাড়ী ঘরের কোনো চিহ্ন ছিলো না। মাদ্রাসার ছাত্ররা মৃত্যু ভয়ে জঙ্গল ও ধান ক্ষেতে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য নারীর উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় এবং পুরুষ ও শিশুদের ধরে এনে বেয়নেট চার্জ ও গুলি করে হত্যা করেছে। পীরের নির্দেশ ও হানাদার বাহিনীর সহযোগীতায় শর্ষিণা মাদ্রাসার ছাত্র তথা তালেবে এলেম রাজাকাররা স্বরূপকাঠির শিল্প শহর ও বন্দর ইন্দোরহাট পুড়িয়ে দেয় এবং প্রায় ১ হাজার নিরীহ লোককে হত্যা করে। তবে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধে সেখানে ২২ জন তালেবে এলেম রাজাকার ও হানাদারসৈন্য নিহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শর্ষিণার পীরের বাড়ী ছিলো হানাদার বাহিনীর একটি দুর্ভেদ্য দূর্গ। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও পাঞ্জাবী পুলিশ অবস্থান করে বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালায় এবং রাজাকারদেরকে ট্রেনিং প্রদান করে।
শর্ষিণার পীরের নেতৃত্বে সেখানকার দালালরা নিরপরাধ বাঙালীর উপর কি ধরনের নির্যাতন চালিয়েছে তার একটি বর্ণনা হিসেবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী মহিলার জবানবন্দি এখানে উদ্ধৃত করা হলো-
*....এক মেয়েকে পেয়ারা বাগান থেকে ধরে এনে সবাই মিলে পাশবিক নির্যাতন চালায়। তারপর তিনদিন যাবৎ ব্লেড দিয়ে শরীর কেটে কেটে লবন দিয়েছে। অশেষ যন্ত্রণা দেয়ার পর মেয়েটিকে গুলি করে হত্যা করে। মেয়েটি মেট্রিক পাশ ছিলো। অন্য একজন মহিলাকে ধরে এনে অত্যাচার চালিয়ে গুলি করে সেদিন। এখানে শতশত লোককে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে।....*
অথচ এই মূখ্য রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী ঘৃন্য দালাল আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ'কে ১৯৮০ সালে জনসেবা এবং ১৯৮৫ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে দু'দুবার স্বাধীনতা পদক প্রদান করে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগকে অপমান করা হয়েছে, করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবলুপ্তের জোর প্রচেষ্টা। আজও সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহল। এই কুচক্রী মহলের ছত্রছায়ায় মুক্তিযুদ্ধে চরম বিশ্বাসঘাতক, রাজাকার, আলবদরদের গাড়ীতে বারবার লাল-সবুজের পতাকা উড়েছে পতপত করে। রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করে স্বাধীনতাকে করেছে ভূলুণ্ঠিত। তারই ধারাবাহিকতায় মূখ্য রাজাকার শর্ষিণার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ'র পুত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, জনপ্রিয় মিডিয়া ও কৃষি ব্যক্তিত্বে পরিণত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল আওয়ামীলীগ সরকারের একজন মন্ত্রী স্বাধীনতা পদকের জন্য রাজাকার পুত্র শাইখ সিরাজের নাম প্রস্তাব করে বুঝিয়ে দিয়েছেন এ'দেশে মুক্তিযুদ্ধকে কেউ আর বুকে ধারণ করে না। বক্তৃতা বিবৃতিতে যতটুকু প্রকাশ করা হয় তা জাতির সাথে, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে চরম প্রহসন বৈ ভিন্ন কিছুই নয়। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে দেখতেন তার স্বপ্নের সোনার বাংলার কি বেহাল দশা!
এখন প্রশ্ন আসবে শাইখ সিরাজের পিতার অপরাধের দায় সে নেবে কেনো? তাকে অভিযুক্ত করা হবে কেনো?
তার পিতার দায় তার উপর বর্তাবে, কারণ তার পিতার অপকর্মের জন্য তিনি কখনই জাতির কাছে ক্ষমা চান নি। তাকে অভিযুক্ত করতে হবে, যেমনভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে রাজাকারকুলের শিরোমণি গোলাম আযমের পুত্রকে। কোনো রাজাকার ও রাজাকারের সন্তানকে কোনোরূপ সুযোগ দেয়া যাবে না, সুযোগ দেয়া যাবে না অনেক ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া মানচিত্রে আবার ছোবল দেয়ার জন্য। তাদেরকে বিশ্বাসও করা যাবে না, কারণ রাজাকারকা বাচ্চা কাভি নেহি আচ্ছা, জো আচ্ছা ও ভি শুয়োরকা বাচ্চা।
(*চিহ্নিত উদ্ধৃুতটি নেয়া হয়েছে 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র' গ্রন্থের অষ্টম খণ্ড থেকে)।