তামান্না ঝুমু

ব্লগার ও লেখক

এই পৃথিবীটা শেয়ারিং ও কেয়ারিং এর

আমি এখন যিশু ও হাঁসের মতো ভাসমান! একেক সপ্তাহে একেক জায়গায় কাজ করতে হচ্ছে। এই সপ্তাহ কাজ করছি আরেকটা স্পেশাল স্কুলে। এটা অটিস্টিক বাচ্চাদের স্কুল। বিশাল স্কুল, অনেক স্টুডেন্ট। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায় এই বাচ্চাদের দেখলে।

আমাদের ক্লাসে ১০জন বাচ্চা। এদের মধ্যে দুইজন শুধু একটু একটু হাঁটতে পারে। বাকিরা সার্বক্ষণিকভাবে হুইলচেয়ারে। ১০-১২ বছরের মধ্যে এদের বয়স। দুইজন ছাড়া বাকিরা কেউ বাথরুমে যেতে পারে না। ডায়াপার পরে ওরা। আমরা ওদের ডায়াপার পাল্টায়ে দিই দিনে কয়েকবার করে। দুই তিনজনে মিলে কোলে তুলে ওদের ডায়াপার পাল্টানোর টেবিলে তুলি আমরা। তারপর একজন ডায়াপার পাল্টাই, পরিষ্কার করে দিই, আরেকজন হাতগুলি ধরে রাখি ওর। হাত যদি দিয়ে দেয় ডায়াপারের এলাকায় এবং তা পুরো শরীরে লাগিয়ে দেয়!

কয়েকজনের জন্য আছে সার্বক্ষণিক নার্স। ওদের নানান রকমের অষুধ দিতে হয়। ইনজেকশন দিতে হয়। অনেক রকমের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয় অনেকের শরীরে। একজনের তো পুরো শরীরটাই যন্ত্রে মোড়ানো। অনেকেই আমাদের মতো খাবার খেতে পারে না। তাদের জন্য অন্য রকমের স্পেশাল খাবার। আমরা ওদের খাইয়ে দিই মুখে তুলে তুলে। ওরা আমাদের মতো করে খেতে পারে না। খাবারটা মুখ থেকে পড়ে যায় ওদের। আমরা বারবার ওদের মুখ মুছে পরিষ্কার করে দিই। ওরা হাত মুখে দেয় এবং খাবারযুক্ত হাতগুলি দিয়ে পুরো শরীর স্পর্শ করে; ওদেরও আমাদেরও। আমরা পরিষ্কার করি, কাপড় পালটিয়ে দেই। কেউ কেউ তো মুখে কিছুই খেতে পারে না। ওদের পেটের মধ্যে ছিদ্র করে টিউব লাগানো আছে। সে টিউব দিয়ে ওদের খাবার খাইয়ে দেয় নার্স।

টিচার নার্স ও ডাক্তাররা ওদের জন্য নাচে, ওদেরকে গান বাজিয়ে ও গেয়ে শোনায়। ওদেরকে গল্প শোনায়, ওদের জন্য ছবি আঁকে। নানান ধরনের খেলা খেলে ওদের সাথে। কী যত্ন আর ভালোবাসার সাথে ওরা কাজগুলি করে! কারো কখনো কুঞ্চিতভ্রূ কুঞ্চিতনাসিকা বা কুঞ্চিতললাট দেখি না এদের ডায়াপার পাল্টানোর সময়ও। আমি অবাক হয়ে যাই। কারো মলমূত্র কোনো অনাত্মীয় এভাবে অম্লানবদনে স্মিতহাস্যে পরিষ্কার করতে পারে দিনের পর দিন?

আমার মেয়েটি (যাকে আমি টেক কেয়ার করছি) মুখে খেতে পারে না। নার্স তার পেটের টিউব দিয়ে তাকে খাইয়ে দেয় তরলজাতীয় কিছু। আহা বাছা! মুখ দিয়ে খেতে পারে না এতটুকু বাচ্চা! কার বুকের মানিক তুই, কার সন্তান তুই, জানি না আমি। আমার বুকের ভেতর যে মোচড় দিয়ে ওঠে তোর পেটের ভেতর টিউব দিয়ে তরল খাবার ঢোকাতে দেখে। কতভাবে কতরকমের রসনাবিলাস করি আমরা। আর তুই কিছুই খেতে পারিস না! আমার চোখে বন্যা নামে। আমি বাথরুম ব্যবহারের নাম করে বাথরুমে গিয়ে কিছুক্ষণ চোখের নোনা জল ফেলে আসি। ওদের একেকজনের দিকে তাকাই আর আমার চোখে বৃষ্টি নামে। আমি আমার সহকর্মীদের আড়াল করে আস্তে চোখ মুছি। ওরা কেউ দেখে ফেললে আমায় জিজ্ঞেস করে, তোমার চোখে কী? আমি বলি, চোখ চুলকাচ্ছে বড়।

এরা কার বাচ্চা? এরা কি অন্য কারো বাচ্চা? আমার তো মনে হচ্ছে, এরা সবাই আমার বাচ্চা। এরা কি আমার বাচ্চা নয়? পেটে না ধরলে বা স্পার্ম না দিলে কি বাবামা হয় না? আর পেটে ধরলে বা স্পার্ম দিলেই কি বাবামা হওয়া যায়? এরা সবাই কি আমার বাচ্চা নয়? আপনার আমার আমাদের সবার বাচ্চা নয়? শুধু এরা কেনো, পৃথিবীর সকল বাচ্চাই কি আমাদের সবার বাচ্চা নয়? তেমনি আমার কন্যারা কি শুধুই আমার কন্যা? ওরাও তো সবার সন্তান, এই পৃথিবীর সন্তান, এই প্রকৃতির সন্তান! সাধ তো হয়, পৃথিবীর সব সন্তানদের নিজের হাতে খাওয়াই পরাই; বুকে জড়ায়ে ধরি। সাধ্য যে নাই! সবাইকে খাওয়ানো পরানোর সাধ্য নাই আমাদের কারো, কিন্তু ভালোবাসার সাধ্য তো আছে আমাদের সবার। ভালোবাসতে যে পয়সা লাগে না। লাগে শুধু হৃদয়।

আমার মেয়েটিকে নিয়ে আজ ক্লাসরুমে স্মার্টবোর্ডে কার্টুন দেখছিলাম পাশাপাশি চেয়ারে বসে। ও হঠাৎ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ ওর কাজল ডাগর দুটি চোখ মেলে। কী যে মায়া সে চাহনীতে! কোনো বাঙালির সন্তান ও। অলিভের মতো শ্যামল সুন্দর ওর গায়ের রঙ। মেঘের মতো চুল। কী বুঝে জানি, একটু হাসে। কী মিষ্টি সে হাসি! হঠাৎ এবার আমার একটি হাত টেনে নেয়। নিজের নিজের কপোলের সাথে চেপে ধরে রাখে। আমার কোলের ওপর শুয়ে পড়ে। ওর মাথায় আমি হাত বুলিয়ে দিই। আমার সহকর্মীরা বলে, তোমাকে ওর মা মনে করেছে। কথা ও বলতে পারে না তেমন। কে বলে, ও কথা বলতে পারে না? কালো দু’টি চোখ দিয়ে কতো হাজার কথা বলে যায় দিনমান!

এখানে মাত্র দু’দিন কাজ করে আমি কতকিছু যে অর্জন করলাম, এইসকল বাচ্চাদের কাছ থেকে, এখানে বাচ্চাদের সাথে যারা কাজ করে তাদের কাছ থেকে! সারা বিশ্বই তো আমাদের বিদ্যালয়। আমরা সবাই তো এই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট। এবং শুধু মানুষের কাছেই তো আমরা শিখি না। আমরা নদীর কাছে শিখি, গাছপালার কাছে শিখি, ঘাসের কাছে শিখি, পশুপাখিদের কাছে শিখি। ভালোবাসতে শেখাটা হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান শিক্ষা। এবং পৃথিবীটা শুধু মানুষের জন্যও নয়। কুকুর বেড়াল তেলাপোকা মাছি মশা হাতি গাছপালা ইত্যাদি সবার জন্য। এবং আমরা মানুষেরা কেউ কেউ যদি নিজেদেরকে অন্য কোনো প্রাণীর চেয়ে উন্নতমানের মনে করি, সেটা হবে হীনচিন্তা। আমরা মানুষেরা পৃথিবীতে অন্যান্য প্রাণির মতো এক প্রজাতির প্রাণী ছাড়া আর কিছু নই। এই পৃথিবীটা শেয়ারিং ও কেয়ারিঙের। এবং আমার ভালোবাসা এই পৃথিবীর সবার জন্য। শুধু মন্দ লোকেদের কাছ থেকে আমি নিরাপদ দূরত্বে থাকি। কারণ দুর্জন সর্বদাই পরিত্যাজ্য, সে যে বা যারাই হোক না কেন।

1803 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।