শামীম আজাদ

কবি, লেখক।

এই পৃথিবীর লক আপে প্রেম হয় না হত্যা হয়

পৃথিবীর লক আপে আমি ছাড়াও আরো যে কে কে আছে তা মনেই থাকে না। মনেই আসে না সেই বেবীকালেই আত্মপ্রেম বা আত্মচিন্তা বোধ অংকুরিত হবার সময়েই আরো যে কি কি ছিলো! এই খয়েরী ত্বকের ভেতরে প্রবেশের কালেই হয়তোবা আমারই দেহের চাপে পড়ে পিষে গেছে সঙ্গমরত অনুপোকা ও তার প্রেমিকা অথবা তাদের বেবী। ওরাওতো লক আপে ছিলো হয়তোবা। আশ্চর্য! আর আমি গ্রেপ্তার হবার সময়ই পৃথিবীর প্রথম অপরাধটি সম্পন্ন করে ফেলেছি। আমাকে কেন্দ্র করে নানাদিকে অপরাধের ধূম পড়ে গেছে। বাজনা বাজছে খুনের, তূণের এবং ভ্রূণের।

সে সময় ঠিক আমার জন্ম সংবাদ পেয়েই যা কান্ড করেছিলেন সে আর কি বলবো? তিনি সালোয়ার গুটিয়ে দৌড়ে বাগানে নেমে গেছিলেন আর সন্তানের জন্য নির্বাচিত ফুলের মধু আহরনকারী মৌমাছিটিকে ভয় দেখিয়ে তাড়া দিয়ে বাগান থেকে কেটে এনেছিলেন নয়টি কুসুম। কুসুমের ভেতরে যাঁরা ছিলেন, সেই বৈশাখেই তাদের বুকে মাত্র যাঁরা বিছানা নিয়েছিলেন, তাঁরা আর ঘুমোতে পারেন নি। ইনসোম্‌নিয়ায় পাগল হয়ে ঐ অধিক বয়সীরা পালাতে অপরিচিত প্লাস্টিকের গা বেয়ে নামতে গিয়ে পিছলে পড়ে মরেই গেছেন। তাদের সৎকার করা যায় নি। এদিকে বাড়ির ভেতরে সারা ঘরে ধূপের ধোঁয়া এবং পালাক্রমে এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে খাটের নিচে, তোশকের তলায়, রুটির ফাংগাসে চা কাপের কর্নারে যুবা বয়সীদের এ্যাজমা বাড়িয়ে নিশ্চল করে ফেলা হয়েছিলো। আমিও ঠিক তখনই ইনফ্যান্টাইল জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছি। কিন্তু কেউ জানে নি। বোঝে নি। থামে নি।

আমার জন্মের পর আতুর ঘরে প্রবেশ পথে জলন্ত অংগার রাখা হতো। আম্মা প্রতিবার প্রক্ষালন থেকে ফিরে ঘরে প্রবেশের পথে আগুনে পা সেঁকে সেঁকে হাত ঘষে ঘষে কম পক্ষে খুন করেছেন নব্বুই থেকে নয়’শ মিনি প্রাণ। লোক খাওয়ানোর জন্য তখন রান্না ঘরে সাতকড়া দিয়ে ভূনা হয়েছে সদ্যমৃত কচি বাছুরের মাংস। কেউ রাগত মৌমাছির মনের কথা ভাবে না। কেউ গাভীমাতার করুণ ও ক্লান্ত চোখের দিকে তাকায় না। তার খাঁটি দুধ আমারই জন্য জার্মান ফ্রিজে তুলে রাখা হয়েছে।

আমার আগমণের আনন্দে বাবা আরেকটি কান্ড করেছিলেন। আনন্দে কোলেস্ট্রেরল আক্রান্ত আদুরী নামের বিড়লীকে অতি আহারে তার কোলস্টেরল ও ডাইবেটিস বাড়িয়ে হার্ট এ্যাটাকের সম্ভাবনার শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছিলেন। সে যখন বাবার কোলে বসে একদিন লোমের নিচে ঘামে ভিজিয়ে হাঁপাচ্ছিলো তিনি ভাবছিলেন সে আমার প্রতি জেলাস হয়ে গোঁ গোঁ করছে। তিনি আমার আম্মাকে ডেকে বলেছিলেন, শিলু দেখো দেখো আদুরী কি ভাবে পুতুর দিকে রেগে রেগে তাকাচ্ছে। তারপরে প্রায়ই নাকি রেগে রেগে গোঁ গোঁ করতো। সবাই তাকে ঝাঁটা পেটাতো। পাঁচ বছর হলে শুনলাম আমার জন্য জেলাসিত হয়ে মরেই গেছিলো।

আসলে মনে রাখবেন। এই পৃথিবীর লক আপে প্রেম হয় না হত্যা হয়। আমরা এখানে আমাদেরই আগোচরে প্রেমের আলমারি ও মিটসেফে হত্যা সাজিয়ে রাখি। ঊটের চামড়ার বুট পরে পায়ের নিচে ধংস এঁকে এঁকে নিজ-মাংস নিরাপদ রাখবো বলে আমরা দেহ খাঁচার খাঁজে খাঁজে ভ্যাক্সিন ভরি। আকাশে ঊড়ন্ত সন্তানহারা পাখির ছবি তুলে ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় পাঠাই, উপহার দেই, তাই দেখে দেখে পেইন্টিং করি। জানি না বা জানতেও চাই না সে পাখিরা ক্ষুধার্ত হয়ে পাগল হয়ে ঊড়ছে কিনা। অথবা মরার আগে শেষ উড়াল দিচ্ছে কিনা। এ তার বিদায়ী উড়াল কিনা।

নাহ্‌ আর ভাবা যাচ্ছে না। মাছের সাপের সজারু ও শুশকের কথাতো বলাই হলো না।

3638 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।