আহমেদ সায়েম

লেখক একজন সমাজ সচেতন অনলাইন একটিভিস্ট। এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখেন যেখানে নারী পুরুষের কোন বৈষম্য থাকবে না।

বেগম রোকেয়া ও তসলিমা নাসরিন এবং বর্তমান প্রজন্ম

বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২) বাঙালি মুসলমান পিতৃতন্ত্রের কাছে এক মহীয়সী নাম। আমাদের এই অঞ্চলের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে বিদ্রোহীরা ক্রমশ হয়ে ওঠে প্রথাগত এবং ব্যর্থ। তাই রোকেয়াকেও উপমহাদেশের পুরুষতন্ত্র, মহীয়সী পুন্যময়ী সতী নারী বা একজন মুছলমান ভদ্রমহিলা ভাবতে সুখ ও স্বস্তিবোধ করে। কিন্ত্ত আমরা দেখতে পাই, রোকেয়ার সমগ্র রচনাবলী ভড়ে আছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তীব্র ঘৃণা।

'পুরুষ' ধারণাটিই ছিলো তার কাছে আপত্তিকর, পুরুষতন্ত্রকে যে তিনি সামান্য করুণা করেছিলেন তা সম্ভবত তাঁর ভাই ও স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে। বোধকরি পশ্চিমে প্রথম নারীবাদী মেরি ওলষ্টোনক্রাফটের মধ্যেও এতো বেশি পুরুষবিদ্ধেষ ও দ্রোহিতা দেখা যায় না। রোকেয়া পুরুষকে বলেছেন অপদার্থ দুশ্চরিত্র পাপিষ্ঠ শয়তান পাশবিক। তবুও রোকেয়াকে রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজ, পুরুষতন্ত্র পূজা করে। কারণ রোকেয়াও এক সময়ে গিয়ে ধর্মের সাথে কিছুটা সন্ধি করেছেন আত্মরক্ষার জন্যে।

নইলে তাঁকে ও তাঁর আর্দশকে অত্যন্ত বিপন্ন করে তুলতো মুছলমান পিতৃতন্ত্র। (পুরুষতন্ত্র ও রোকেয়ার নারীবাদ: হুমায়ূন আজাদ)

বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশই জানে না যে, রোকেয়ার রচনাবলি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ধারাবাহিক মহাযুদ্ধ।

এমন কি এই অঞ্চলে প্রথাগত পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়েও তিনি চিন্তা -চেতনায় অনেক এগিয়ে ছিলেন। রোকেয়া যে আজও আমাদের পাঠ্য ও পূজনীয় তার কারণ ওই একটাই রোকেয়ার মর্ষকামীতা ও ব্রহ্মচর্যতা। তাই এখানেও তিনি রক্তাত্ব করে দিয়েছেন পুরুতন্ত্রকে।

তিনি বলেছেন, "আশরাফগণ সপ্তম বর্ষীয়া বিধবা কন্যাকে চির বিধবা রাখিয়া গৌরব বোধ করেন। আমি যে ২২ বত্‍সর যাবত বৈধব্যের আগুণে পুড়েছি।"

এর পর রোকেয়া যে তাবৎ পিতৃতান্ত্রিক কাঠমোকে একের পর এক আক্রমণ করে চলেন, তা আমরা দেখতে পাই তাঁর ধারাবাহিক লেখাতে।

রোকেয়ার, 'স্ত্রীজাতির অবনতি' প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে (১৩১০ বঙ্গাব্দে) সম্পাদিত  মাসিক মহিলা পত্রিকায় পরপর তিন সংখ্যায়, ধারাবাহিকভাবে। তখন এর শিরোনাম ছিলো 'অলঙ্কার না Badge of Slavery?'। পরে 'আমাদের অবনতি' নামে সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত নবনূর পত্রিকায় এটি পুর্নমুদ্রিতহয়। উভয় ক্ষেত্রে প্রবন্ধে ব্যক্ত রোকেয়ার ধর্ম- সম্পর্কিত কিছু মন্তব্য বা অভিমত একশ্রেণির পাঠকের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। যেমন রোকেয়া তাঁর প্রবন্ধে বলেছিলেন:

"আমাদিগকে প্রতারণা" করিবার নিমিত্ত পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে 'ঈশ্বরের আদেশপত্র' বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।...এই ধর্মশাস্ত্রগুলি পুরুষ-রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে- কথা শুনিতে পাও, কোনো স্ত্রী মুনির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত  নিয়ম দেখিতে পাইতে। ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বরপ্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে।"

প্রশ্ন তুলেছিলেন, "যদি ঈশ্বর কোনো দূত রমণী-শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধহয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ  থাকিতেন না। দূতগণ ইউরোপে যান নাই কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত যাইয়া 'রমণী জাতিকে নরের অধীন থাকিতে হইবে' ঈশ্বরের এই আদেশ  শুনান নাই কেন? ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর?"

প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার পর  মহিলা ও নবনূর দুটি পত্রিকায়ই রোকেয়ার বক্তব্যের প্রতিবাদ করে একাধিক পত্র ও নিবন্ধ ছাপা হয়। বিরূপ সমালোচনার মুখে রোকেয়া অবশ্য (বইয়ে অন্তর্ভুক্তির সময়) তাঁর প্রবন্ধের এই অংশটুকু বাদ দেন। তারপর, 'স্ত্রীজাতির অবনতি'র এক অংশে পুরুষ ও ধর্মকে এক সঙ্গে আক্রমণ করে বলেন:

"দাসী" শব্দে অনেক শ্রীমতী আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, "স্বামী" শব্দের অর্থ কি? দানকর্ত্তাকে "দাতা" বলিলে যেমন গ্রহণ কর্ত্তাকে "গ্রহীতা" বলিতেই হয়, সেইরূপ একজনকে "স্বামী, প্রভু, ঈশ্বর " বলিলে অপরকে "দাসী" না বলিয়া আর কি বলিতে পারেন?

অর্দ্ধাঙ্গী'তে ধর্মকে বিদ্রূপ  করে বলেন: পুরুষগণ স্ত্রীজাতির প্রতি যতটুকু সম্মান প্রদর্শন করেন, তাহাতে আমরা সম্পূর্ণ তৃপ্ত হইতে পারি না। লোকে কালী, শীতলা প্রভৃতি রাক্ষস-প্রকৃতির দেবীকে ভয় করে, পূজা করে, সত্য। কিন্তু সেইরূপ বাঘিনী, নাগিনী, সিংহী প্রভৃতি "দেবী" ও কি ভয় ও পূজা লাভ করে না? তবেই দেখা যায় পূজাটা কে পাইতেছেন,-রমণী কালী, না রাক্ষসী নৃমুণ্ডমালিনী?

বেগম রোকেয়া (ছবিঃইন্টারনেট)

কিন্তু বেগম রোকেয়ার রচনাবলী থেকে মূল বক্তব্য বাদ দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র রোকেয়াকে করে তুলেছিলেন মহীয়সী। পূজনীয়দের নারীবাদ। কোমল নারীবাদ। 

তারপর আমরা অনেক পরে দেখতে পাই রোকেয়ার এক উত্তরসূরীকে। তসলিমা নাসরিনকে। ফের আমাদের অঞ্চলেই। তসলিমা  নাসরীন আবারো আমাদের স্বরণ করিয়ে দেন, ভুলে যাওয়া শব্দ পিতৃতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র। এবং সার্বিক আক্রমণ চালাতে চেষ্টা করেন সকল ভাবমূর্তি ভেঙে ফেলার জন্যে। অনেকটা রোকেয়ার মতো। বর্জন  করেন সমস্ত প্রথাগত ভূমিকাকে, এবং বলপ্রয়োগসংস্থা তার ধর্মকে। তবে তা রোকেয়ার মতো হয়ে ওঠে না। কারণ তসলিমা নাসরিন আত্মরক্ষার জন্যে সন্ধিতে রাজি হন নি। সতীপনাও দেখান নি। রোকেয়ার মতো পুরুষতন্ত্র ও মোল্লতন্ত্রকে মেনে নিয়ে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন নাই।

তাই বাংলাদেশের পিতৃতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র তার উপর হামলে পড়ে তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেন। এরপর তসিলামকে ত্যাগ করে তাঁর সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম। তবুও তসলিমা লড়াইয়ে অস্ত্রসরূপ নিয়েছিলেন প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসকে। কিন্ত্ত তাঁর পৌনপুনিক আক্রমণে পুরুষতন্ত্র তাকে ছিঁড়ে ফেঁড়ে ফেলতে চায়। হায়েনা বলে। তাঁর স্বাধীন জীবন -যাপনকে তারা অবৈধ বলেন। অথচ বর্তমান প্রজন্ম দুই জনকে খুব বেশি না পড়েই একজনকে গ্রহণ করতে চাচ্ছেন, অপরজনকে ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছেন।

তসলিমা নাসরীন (ছবিঃ ইন্টারনেট)

কিন্ত্ত আমরা জানি রোকেয়া তসলিমার চেয়েও আমূল নারীবাদী। রোকেয়া পুরুষতন্ত্রের একটি কাঠামোকেও বাদ দেয় নি আক্রমণ থেকে এবং ধ্বস নামাতে। কিন্ত্ত বর্তমান প্রজন্ম কিছু না পড়েই তসলিমা নাসরিন নামে কেঁপে উঠেন। খেপে উঠেন। অশ্লীল ভঙ্গি করেন। খিস্তি করেন। তাঁর মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নিতে চান এবং পিতৃতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র একজোটে রাস্তায় শ্লোগান দিতে চান। একটি মাত্র মানুষের বিরুদ্ধে।

আসলে পুরুষতন্ত্র যেমন এক সময় রোকেয়াকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিলো। আজ তসলিমাকেও তেমনি নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে বা দিতে চাচ্ছে। প্রমাণ আমরা পাচ্ছিও, তাদের  উত্তরাধিকার নারীদের দেখে। তাদের অধিকাংশই আজ সেই কথিত ভদ্রমহিলা, স্বামীর শিক্ষিত দাসী ও প্রমোদসঙ্গিনী, সামাজিক সুবিধাভোগী, এবং এই তারাই তখন ব্যর্থ করে দিয়েছিল রোকেয়াকে। এখন  করতে চাচ্ছে বা করে যাচ্ছে তসলিমা ও বর্তমান প্রজন্মকে। এবং বর্তমান প্রজন্মের বিশাল অংশই আজ রোকেয়া পূজারী হলেও ( মূল ও প্রথম রোকেয়াকে নয়?) প্রবলভাবে  তসলিমা বিদ্বেষী। সময়ে কি আজও কিছু বদলিয়েছে? আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, 'না'। তবে আমরা প্রত্যাশা  করি “আলো হাতে একদিন না একদিন আধাঁরের যাত্রীরা হাঁটবেই।" আধাঁর কেটে আলো আসবেই।

2677 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।