প্রায়ই একটা কথা শুনি, নারী পুরুষ সমান অধিকার। এই সমান অধিকার কথাটা আমার কাছে একটা ভাওতাবাজী বলে মনে হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি “নারী পুরুষ সমান অধিকার” স্লোগানের বিপক্ষে। আমার মতে, সমান নয় বরং নারীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর্থ- সামাজিক প্রেক্ষাপটের সীমাবদ্ধতার কারনে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুযোগ না থাকলেও অন্তত ন্যায্য অধিকার দিতে হবে। আমার কথা শুনে পুরুষদের, এমনকি সাম্যবাদী অনেক নারীদেরও পিলে চমকে উঠতে পারে। তাই একটু স্পষ্ট করেই বলি কে আমি সমান অধিকার না চেয়ে অগ্রাধিকার চাচ্ছি।
ধরুন, আপনার কাছে ৫০ টাকা আছে, আর আপনার বোনের কাছে আছে শূন্য টাকা। এখন যদি আমি আপনাকে আরো ৫০ টাকা দিই, আর সমান অধিকার বিবেচনায় আপনার বোনকেও ৫০ টাকা দিই তাহলে ঘটনাটা কি দাঁড়ায়! আপনার আগেই ৫০ ছিলো, আমার কাছ থেকে আরো ৫০ পেয়ে আপনার ১০০ টাকা হলো । অন্যদিকে আপনার বোনের কাছে কোনো টাকাই ছিলো না, তাকে আমি ৫০ দিলাম। সমাজের চোখে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা পেলো ঠিকই কিন্তু গনিত আমাদের বলে দিচ্ছে আগেও আপনি বোনের চাইতে ৫০ টাকা এগিয়ে ছিলেন আর এখনো আপনি বোনের চাইতে ৫০ টাকা এগিয়েই আছেন। বাস্তব অবস্থার কোনো পরিবর্তন ই হলো না। ক্ষমতা তখনো আপনার হাতে ছিলো, এখনো আপনার হাতেই আছে। এখানে আমি ৫০ টাকার একটা সামান্য উদাহরণ দিলাম মাত্র। পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজবাস্তবতা আরো নির্মম। সেক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিকতার দয়া- দাক্ষিণ্য গ্রহন করে, নারী পুরুষ সমান অধিকারের বুলি আওড়ে আমি অন্তত খুশি নই ।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখবো, এই নারী পুরুষ সমান অধিকারের ভাওতা দিয়ে আসলে নারীদের আরো বেশী অপদস্ত করারই চেষ্টা করা হচ্ছে। দশ বছর আগেও বাসে কোনো মহিলা উঠলে তাকে বসার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতো পুরুষেরা অথচ এখন জায়গা ছেড়ে দেওয়া তো দূরের কথা উল্টো অনেক পুরুষেরা মহিলা সিট দখল করে বসে থাকেন। সিট ছাড়তে বললে দাঁত কেলিয়ে বলেন, ক্যান আপা নারী পুরুষ তো সমান অধিকার তাইলে পুরুষ দাঁড়িয়ে যেতে পারলে আপনারা পারবেন না ক্যান। বাসে দাঁড়িয়ে যাওয়া কোনো সমস্যাই না যদি আমাদের সুসভ্য ভাইয়েরা ভীড়ের সুযোগে নিজেদের পশু প্রবৃত্তিকে দমন করতে পারতেন। অনেকে তো আবার এটাও বলে আরেহ নারী পুরুষ সমান অধিকার, ভীড়ের মধ্যে পুরুষেরা যদি একজন নারীর বুকে গুঁতো দেয়ই তাহলে ওই নারী চুপ করে থাকে কেনো, সেও পুরুষটিকে অমন করে গুঁতো দিতে পারে না? আমি জানি না তাদের স্ত্রী কন্যাদের বেলায়ও তাদের এই যুক্তি খাটবে কিনা।
নারী কোটা নিয়ে প্রচুর কথা হয়। অনেক নারীরাও নারী কোটার বিরোধী। নারী কোটার পক্ষে বিপক্ষে বলার আগে আমাদের পরিবারের দিকে একটু তাকাই চলুন। আমার বাবা অবসরে প্রচুর বই পড়তেন অন্যদিকে আমার মা কে আমি কখনো বই হাতে নিতে দেখিনি। তিনি যে বই পড়তে পছন্দ করতেন না তা নয়, সংসারের সমস্ত কাজ সামলে তিনি আসলে পড়ার সময় পেতেন না। মাঝে মাঝে আমাকেই ডেকে বই পড়ে শোনাতে বলতেন। আমি পড়ে শোনাতাম আর তিনি কাজ করতে করতে শুনতেন।
গ্রাজুয়েশনের পরে একটা ছেলে চাকরির চেষ্টা করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শতকরা ৮০-৮৫% মেয়ের গ্রাজুয়েশনের পরপরই বাবা মা বিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হন। সংসার সামলে একটা মেয়ের চাকরির জন্য পড়াটা কতটা টাফ সেটা তো কারোর না বোঝার কথা নয়? এজন্যই হয়তো একাডেমিক লেখাপড়ায় নারীরা এগিয়ে থাকলেও চাকরির বাজারের প্রবল প্রতিযোগিতায় নারীরা ততটা সফল নয়। এই পিছিয়ে পড়ার হাত থেকে তাদেরকে বের করে আনতে যদি ১০% নারী কোটা থাকেই তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না। এটুকু অগ্রাধিকার তারা পেতেই পারে।
হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক শাসন শোষণের নাগপাশ থেকে নারীকে মুক্ত করতেই যদি হয় তবে সমানাধিকার দিয়ে নয়, অগ্রাধিকার দিয়ে করতে হবে। এত বছরের পিছিয়ে পড়ার ঘাটতি পুরণ না করে শুধু আজকের দিনের অধিকারটুকু নাম মাত্র প্রদান করেই ভাবা হলো নারীমুক্তি সাধিত হয়েছে এর মতোন ভন্ডামি আর কি হতে পারে!