টিম হর্টনসে কাজ করি আমি। এটা ক্যানাডার সবচেয়ে বড় কফি শপ ফ্রাঞ্চাইজ। যে স্টোরে আমি কাজ করি, সেখানে প্রতিদিন নিয়ম করে একটা তরুণী মেয়ে আসে। দেখতে খুবই সুন্দরী, শেতাঙ্গিনী। প্রতিদিন আসার পরেই প্রথমে এটা সেটা চায়, জিজ্ঞেস করে নানা ধরনের খাবারের কথা। দাম জিজ্ঞেস করে, কিন্তু কেনে না কিছুই। কিছুক্ষণ পরে বলে, “অনুগ্রহ করে একটা বড় গ্লাসে অর্ধেক গরম পানি এবং অর্ধেক ঠাণ্ডা পানি দেবে?” প্রথম দিন বেশ খুশি হয়েই তাকে পানি দিলাম। এরপর দেখি প্রতিদিন আসে শুধু একগ্লাস পানির জন্য। অন্য কিছু কেনে না। ধীরে ধীরে আমি খুশির পরিবর্তে বিরক্ত হতে শুরু করলাম। পানি খাবে, বাসা থেকেই আনলে পারে। এখানে এসে আমাদের বিরক্ত করার প্রয়োজন কী? সেদিন অত শত না বুঝে খানিকটা রাগ হয়েই আমার সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করলাম,
“তুমি কি ওই মেয়েটিকে খেয়াল করেছ? প্রতিদিন আসে শুধু পানির জন্য।” সে উত্তরে ও বললো, হ্যাঁ। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কি মনে হয়?”
“মেয়েটি হয়তো একা, নিঃসঙ্গ। ওর হয়তো কেউ নেই কথা বলার জন্য। একটু কথা বলার কারণেই খুব সম্ভবত সে আমাদের দোকানে আসে। তাকে ভালোবাসারও কেউ হয়তো নেই। একা একা বাড়িতে বসে থেকে কী করবে? তাই এখানে আসে।”
আমার সহকর্মীর কথাগুলো শোনার পর মনে হলো, এভাবেতো আগে কখনও চিন্তা করি নাই আমি।
আমার এই সহকর্মীর নাম সেরেনা। আমরা ওকে নাম সংক্ষিপ্ত করে রিনা বলে ডাকি। লম্বায় ছয় ফুট সে, বা তারও বেশি। এও শেতাঙ্গিনী। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। ওর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নোভা স্কশিয়ার এক ছোট্ট শহরে। নোভা স্কশিয়া কানাডার পূর্ব দিকের একটা প্রদেশ।যখন জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি তোমার শহর ছেড়ে টরন্টোতে এলে কেনো? উত্তরে সে বলল, “সমুদ্রের তীর ঘেঁষা ওই শহরটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। কিন্তু ওখানে কোন ব্যস্ততা নেই, নেই বড় ধরনের কোনো সামাজিক কর্মকাণ্ড। আনন্দ করার উপাদানের বড় অভাব সেখানে। ওখানকার জীবনযাত্রা খুবই শ্লথ ধরনের। সবাই কাজ শেষে কফি শপে অথবা বিয়ার শপে বসে আড্ডা দেয় আর এর ওর নামে বদনাম করে। সেই তুলনায় টরন্টো শহর লোকে লোকারণ্য। নানা দেশের, নানা বর্ণের মানুষ দিয়ে বোঝাই এই শহর। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ইভেন্ট নিয়ে মানুষের ছুটাছুটি চলছে। এখানে সবাই ব্যস্ত। এখানে আমি আমার মতো কাউকে নিজের করে না পেলেও অন্তত আমি আমাকে প্রকাশ করতে পারছি। নিজের শহরে সেটা পারতাম না আমি।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেনো, তোমার সমস্যা কোথায়?”
এর উত্তরে সে যা বললো, সেটার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
“তুমি হয়তো জানো না, আমি ট্রান্সজেন্ডার।” আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঠাণ্ডা স্বরে সে বলে।
আমার কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। ট্রান্সজেন্ডার কী, সেটা জানি আমি। কিন্তু, কখনোই এতো কাছ থেকে, এতো ঘনিষ্ঠভাবে কাউকে দেখার কিংবা জানার সুযোগ আমার আগে কখনো হয়নি।
সাথে সাথেই ওকে জিজ্ঞাস করলাম, “তো, তুমি এখন ছেলে না মেয়ে?”
“আমি জন্মে ছিলাম একজন ছেলে বাচ্চা হয়ে। কিন্তু, বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে ধীরে ধীর আমি অনুধাবন করলাম, আমার ভিতরে ছেলে নয়, একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েদের কাপড় পরতে আমার ইচ্ছা জাগে, মেয়েদের মতো সাজতে আমার আনন্দ হয়, মেয়েদের সাথে কথা বলতে, চলাফেরা করতে এবং তাদের সঙ্গ পেতে আমার ভালো লাগে, স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। দীর্ঘ দিন আমি নীরবে এটা নিয়ে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করি। যখন আমার বয়স ২৪ বছর, তখন একদিন সাহসের সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম, এভাবে আর না। আমি আমাকে প্রকাশ করবোই, নিজেকে এই ভিন্ন লিঙ্গের কাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে রাখবো না। এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েই নিজের শহর ছাড়ি আমি। ওখানে এই কাজ করাটা অসম্ভব না হলেও, বেশ কঠিনই ছিলো আমার জন্য। তখনই চলে আসি টরন্টো শহরে। আমি আগে ‘এন্থনি সেরেনা ভেটারস’ নামে পরিচিত ছিলাম। বর্তমানে সবার সহযোগিতায় বিশেষ করে আমাদের দোকানের মালিক এবং দোকানের ম্যানেজারের কল্যাণে রিনা নামে পরিচিত হয়েছি। সরকারিভাবেও আমার আইডেন্টিটি পরিবর্তন করেছি। পুরুষ থেকে নিজেকে নারী পরিচয়ে পরিচিত করেছি। আমি এখন একজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আছি। নিয়মিত হরমোনাল ওষুধ খাই শারীরিক পরিবর্তনকে সুষম করতে।”
“তুমি কি এখন সুখী?” বোকার মতো প্রশ্ন করি আমি।
সে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে, “হাঁ। আমি অনেক সুখী এখন।”
এই মিষ্টি হাসির পিছনেও যে অনেক কষ্ট লুকিয়ে আছে, তা ধীরে ধীরে টের পাই আমি। ফেলে আসা জীবনের যন্ত্রণা ওকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। আমার কফি শপের নিকটেই একটা হাইস্কুল আছে। ওই স্কুলের ছেলেমেয়েরা ওদের লাঞ্চ ব্রেক অথবা স্কুল ছুটির পর আমাদের দোকানে এসে ভিড় জমায়। বিশ থেকে তিরিশ মিনিট ওরা হই চই করে খাবার কিনে। তারপর চলে যায়। এই সময়টা আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই উপভোগ করি। আমার কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড় চোখে আমি স্কুল বাচ্চাদের কর্মকাণ্ড দেখি। কখনো দেখি একটা ছেলে একটা মেয়ের কোলে বসে আছে, কখনো দেখি কোনো ছেলে কোনো মেয়ের চুল বেণী করে দিচ্ছে, কখনো বা দেখি একসাথে চার পাঁচজন দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে ঢোকার চেষ্টা করছে। ওদের হই চই হাসাহাসিতে দোকানটা যেন প্রাণ ফিরে পায়। ওদের দুষ্টামি দেখে আমি আমার স্কুল এবং কলেজ জীবনের দুষ্টামির কথা মনে করি। আমার কাছে পুরো বিষয়টাই খুব স্বাভাবিক এবং আনন্দময় মনে হয়। মনে হয় এই বয়সের বাচ্চারাতো এরকমই করবে। এই স্কুলের বাচ্চাগুলো চলে যাবার পরই দোকানে আবার নীরবতা ফিরে আসে।
কিন্তু এই তিরিশ মিনিটই রিনার জন্য হয়ে উঠতো দারুণ যন্ত্রণাদায়ক। স্কুলের বাচ্চাগুলো আসার সাথে সাথেই আমি দেখতাম, রিনার চোখেমুখে চরম বিরক্তি। অর্ডার নিচ্ছে নিচের দিকে তাকিয়ে, ওর হাত থেকে জিনিস পড়ে যাচ্ছে টপাটপ করে। চিৎকার করছে সে কোনো কারণ ছাড়াই।
একদিন কর্মস্থলে পৌঁছে দেখি অবস্থা কেমন যেন থমথমে। একে ওকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? তারপর জানতে পারলাম, স্কুল ব্রেকে হাইস্কুলের ছেলেমেয়েদের রিনা যখন সার্ভ করছিলো, তখন কয়েকটা ছেলে ওর ছবি তুলেছে। রিনা সেটা দেখে সহ্য করতে না পেরে দোকানের ভিতরের অংশে এসে উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করেছে। আমি শুধু ওকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে যে এই বয়সের বাচ্চারা হইচই করবে এটাই স্বাভাবিক। তুমি কেনো এটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছো না? উত্তরে বলে, “তুমি জানো না, আমার সম্পূর্ণ স্কুল জীবনে আমি বুলিড হয়েছি আমার সমবয়সী ছেলে মেয়েদের দ্বারা । সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি আমি এখনো ভুলিনি। এখন ওদের দেখলেই আমার সারা শরীর কাঁপে নিজের অজান্তেই।” ওর কথা শুনে নিস্তব্ধ হয়ে যাই আমি। বলার কিছু খুঁজে পাই না আমি।
টিম হর্টনসে প্রথম দু’বছর রিনা তার জন্মগত নামেই কাজ করতো। এন্থনির সংক্ষেপ টনি হিসাবেই সবাই ডাকতো তাকে তখন। পরবর্তীতে রিনা অফিসিয়ালি নিজের আইডেন্টিটি পরিবর্তন করলেও কিছু কিছু নিয়মিত ক্রেতা ওর এই নাম পরিবর্তন মেনে নিতে পারে নাই কিংবা তাদের অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে নাই। ইচ্ছাতেই হোক বা অনিচ্ছাতেই হোক, ওকে দেখামাত্র তারা ডাক দিয়ে বলতো, “হাই টনি, হাউ আর ইউ?” ওর জন্য এটা খুব বিব্রতকর এবং লজ্জার বিষয় ছিলো। সে মাঝে মাঝে মৃদু প্রতিবাদ করে বলতো, “আই এ্যাম নো লংগার টনি। আই এ্যাম এ গার্ল এ্যান্ড মাই নেই ইজ রিনা।” কখনো কখনো এই অপমান নিতে না পেরে দোকানের ভিতর এসে বাচ্চাদের মতো কান্না করতো। ওকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পেতাম না আমি।
গত বছর ক্রিসমাসের ঠিক আগের দিন খুব খুশি হয়ে দোকানে আসলো সে। আমি কিছু জিজ্ঞাস করার আগেই সে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বলতে শুরু করলো,, “আফরোজা, প্রায় এগারো বছর পর গতকাল আমার বাবা আমাকে ফেসবুকে খুঁজে পেয়েছে। আমাকে বলেছে ক্রিসমাসের দিন বাবা আমার সাথে ফোনে কথা বলবে। আমার বাবা আমার ফোন নাম্বার চেয়েছে।” আমিও উৎসাহ ভরে জানতে চাইলাম, “কেনো তোমার বাবার সাথে তোমার এতদিন যোগাযোগ ছিলো না? উত্তরে বললো, “না। আমার যখন দশ বছর, তখনই আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যায়। আমি আমার মা এবং নানীর কাছে বড় হয়েছি।”
আমি ওর কথা শুনি আর ভাবি কি করে এই মেয়েটি এতো কিছু সহ্য করে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো বেঁচে আছে এখনো।
অত্যন্ত প্রতিভাবান এই মেয়েটির মধ্যে একটা বাচ্চাসুলভ মেয়েকে আমি খুঁজে পেয়েছি। কাজের ফাঁকে অবসর সময়ে রিনা আমাকে বোর্ড গেম খেলা শেখাতো। ওর ড্রইং এর হাত বেশ পাকা। প্রায়ই দেখতাম আমাদের বুলেটিন বোর্ডে রিনার আঁকা কার্টুন। ছবির মাধ্যমে রিনা ওর মনের নানা চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতো।
একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, “রিনা তুমি এতো সুন্দর ড্রইং কোথা থেকে শিখেছো? সে বললো, “ছোটবেলায় টিভিতে পেইন্টিংর উপর একটা শো দেখতাম। বব রস এর পেইন্টিং শো ‘দ্য জয় অব পেইন্টিং”। এই ভদ্রলোক গল্প বলার সাথে সাথে পেইন্ট করতেন আর তাঁর গল্পের বিষয়বস্তুকে পেইনটিং এর মাধ্যমে তিনি বাচ্চাদের সামনে তুলে ধরতেন। এই বব রসকে দেখেই আমি অনুপ্রাণিত হই।” সেদিনই সে ইউটিউবে গিয়ে আমাকে বব রসের পেইন্টিং দেখালো।
একদিন দুষ্টুমি করে রিনাকে বললাম, “তোমার একজন ছেলে বন্ধু দরকার।” ও সাথে সাথেই মুখটাকে মলিন করে ফেললো,” Yes, Afroja, I really need someone. who will love me, whom I can share all my feelings with.” জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি এখন পর্যন্ত সেরকম কাউকে খুঁজে পাও নাই?” এর উত্তরে সে বললো, “পেয়েছিলাম, কিন্তু সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী হয় নাই।” ওকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আমি বললাম,, “তুমি বরং তোমার পরিবারের কাছে ফিরে যাও। প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তিতে পড়বে তুমি, সেটা জানি আমি। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু ওর সেই একই ভয়। নিজের শহরে যেয়েও যদি ওকে বার বার বলতে হয়, “আই এ্যাম নো লংগার টনি। আই এ্যাম এ গার্ল এ্যান্ড মাই নেই ইজ রিনা।”
অবশেষে এ বছরের আগস্ট মাসে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে, একটু ভালোবাসা পাবার বাসনা নিয়ে রিনা ফিরে গেছে ওর নিজের শহরে। গতকাল রিনার সাথে মেসেঞ্জারে কথা হলো, জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন দিন কাটাচ্ছ?” এর উত্তরে সে বললো, “Things are going well here! I am working on going back to school, get a degree and try to get a career.”
জগতের সব টনি, রিনারা ভালো থাকুক, এটুকুই চাওয়া শুধু আমার।’