একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নিজস্ব মানসিকতা ও আবেগ ছাপিয়ে দায়িত্বশীলতা বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বলতে আমি তাদের বোঝাচ্ছি যারা যেকোনো প্লাটফর্মে বা মতবাদে গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছে বা একটি সম্মানজনক ইতিবাচক বিশেষণ খেতাবপ্রাপ্ত হয়ে সেই সেক্টরে কান্ডারীর ভূমিকা পালন করে থাকেন।
যেকোনো গ্রুপ, সংঘ, মতবাদ, বিশ্বাস ইত্যাদি সবকিছুতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব থাকেন। তাদেরকে ঐ গ্রুপ, মতবাদ, বিশ্বাসের সদস্য বা অনুসারীরা অনুসরণ করেন, অনুকরণ করেন, শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন। এই নেতৃস্থানীয় ক্ষেত্রের পরিধি ব্যাপক। আমি এখানে একটি সেক্টর নিয়ে কথা বলব। সেটা হচ্ছে প্রগতিশীলতা।
সমাজের তথাকথিত সমস্ত জরাজীর্ণ, কুসংস্কার, অন্ধত্ব; যা মানবমুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, মুক্তচিন্তাকে গ্রাস করে, সমাজে শ্রেণিবিভাজন তৈরি করে, মানুষের ন্যায্য অধিকারে বৈষম্যের সৃষ্টি করে সেসবের বিরোধীতা করে সমাজকে আধুনিক, বৈজ্ঞানিক, যুক্তিসংগত, মানবিক, সত্য, ন্যায় ইত্যাদির পথে ধাবিত করার অভিপ্রায়ে যারা বিভিন্নভাবে কাজ করে থাকেন, অবদান রাখেন, বিপ্লব করেন, প্রতিবাদ করেন তাদেরকেই আমরা প্রগতিশীল হিসেবে ধরে নেই।
কেউ কলমসৈনিক হয়ে লেখালেখির মাধ্যমে এই পথে কাজ করেন, কেউ রাজপথে নেমে সংগ্রাম করেন, কেউ তাদের সমর্থন করে পাশে থাকেন, কেউ অনুকরণ বা অনুসরণ করেন। আসলে এর পরিধিটাও ব্যাপক। তাই লেখার স্বার্থে আমি এখান থেকেও একটি বিষয়কে আলাদা করে লিখছি, মূলত এটাই আমার লেখার প্রধান উদ্দেশ্য। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব এবং প্রগতিশীলতার বিশাল পরিধিটা উল্লেখ করলাম কারণ আমার এই লেখার মূল বিষয়টা প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি।
যাহোক, এই প্রগতিশীলতার একটি অংশ হচ্ছে নারীবাদ। নারীমুক্তির আন্দোলনে নারীবাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যারা নারী-পুরুষ-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিজেদেরকে নারীবাদী মনে করেন তারা নারীবাদের পক্ষে কথা বলেন, সংগ্রাম করেন, লেখালেখি করেন। নারীদের সমস্যা, সমস্যার কারণ, সমস্যার সমাধান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তি তর্ক তুলে ধরেন। যার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে নারী-পুরুষ বৈষম্য নির্মূল করে সমাজে উভয়ের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করা।
সঙ্গত কারনেই নারীবাদ বা সমতার পক্ষে কথা বলতে গেলে বিভিন্ন বিষয় চলে আসে, যার মধ্যে পুরুষতন্ত্র ও ধর্ম অন্যতম। এই দুটি বিষয়ের সাথে কন্ট্রাডিকশন ছাড়া নারীবাদ, সমতাবাদ, প্রগতিশীলতা কোনোটাই সম্ভব না।
এখন মূলকথা হচ্ছে যারা নারীবাদের পক্ষে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব তারা আসলে নারীবাদ প্রতিষ্ঠায় কতটুকু দায়িত্বশীল? কথা উঠতে পারে আমি কেনো শুধু নারীবাদীদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি। আমি আগেই বলেছি দায়িত্বশীলতার প্রত্যেকটা সেক্টর আমার লেখার মূলবিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও আমি একটি সেক্টর নিয়ে কথা বলব। তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কারন সম্প্রতি এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যা রীতিমত আমার জন্য বিব্রতকর। কারণ আমি নিজেকে নারীবাদ ও সমতাবাদের একটি অংশ হিসেবে মনে করি। যেহেতু আমি এ বিষয়ে নিজের সীমিত জ্ঞান দিয়ে যতটুকু পেরেছি লেখালেখি করেছি এবং আমার সারাউন্ডিংস ইতোমধ্যে আমার অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত। তাই যৌক্তিক কারনেই এ বিষয়ে আমার মতামত ব্যক্ত করা আমার দায়িত্ব বলে মনে করি। শুধু আমি না, আমার মনে হয় অনেকেই আমার মতো বিষয়টা নিয়ে বিব্রত।
নারীবাদ বা নারীবাদীদের নিয়ে যখন অন্যরা ঠাট্টা -মশকরা করে, নারীবাদীদের নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন সঙ্গত কারনেই সেটা আমাকে অপমানিত করে। তাই এ নিয়ে কোনো কথা না বলতে চাইলেও আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি। কথা বলতে চাইনি কারণ বললে এটা নিয়েও নিন্দুকেরা কথা বলবে, সবাই ঘটনা জানতে চাইবে যা দুর্গন্ধই ছড়াবে। কিন্তু দুর্গন্ধ যেহেতু ইতোমধ্যে আপনারা ছড়িয়েই ফেলেছেন এবং সেটা ভাইরালও হয়ে গেছে সেহেতু আমি বললে আর দোষ কি!
কথা হচ্ছে একের পর এক একজনের সাথে আরেকজনের ব্যক্তিগত রেষারেষি, পছন্দ-অপছন্দ, মতানৈক্য নিয়ে আপনারা যেভাবে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছেন, যেভাবে নিন্দুকের নিন্দা করার পথ মসৃন করে দিচ্ছেন তাতে আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা তো থাকছেই না, বরং ঘৃনা হচ্ছে। কারণ এর বড় একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে নারীবাদ এবং নারীবাদীদের উপর। মানুষ নারীবাদীদের মানসিকতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠছে। আপনাদের মতো বড় বড় ব্যক্তিত্ব যাদের হাজার হাজার ভক্ত, পাঠক, ফলোয়ার তাদের কাছে মানুষ কি শিখছে? প্রতিহিংসা, কাদা ছোড়াছোড়ি থেকে ভালো শিক্ষাটুকুও মলিন হয়ে যাচ্ছে।
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, নারীবাদীরা কি মানুষ না? তাদের মধ্যে মানুষের সহজাত নেতিবাচক প্রবৃত্তি কি থাকবে না? তাদের মধ্যে কি ঝগড়াঝাটি হবে না? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, অবশ্যই হবে। কিন্তু কার বাথরুমে কি আছে সেটা পারস্পরিক মতবিরোধের কারণে বিশ্বের মানুষ কেনো জানবে? ব্যক্তিগত মতবিরোধটা আপনারা কেনো অনলাইনে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতেছেন? মতবিরোধ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে যুক্তিতর্ক করেন। না বনলে একে অপরের সঙ্গ পরিত্যাগ করেন। তাই বলে সেটা নিয়ে এত নোংরাভাবে বিতর্কিত হচ্ছেন কোন মানসিকতায়?
হ্যাঁ, নারীবাদ, ধর্ম, প্রগতিশীলতা বিষয়ে কোন তার্কিক বিষয় আসলে সেটা নিয়ে কৌশলগতভাবে গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা করেন। তা নিয়ে ব্যক্তিগত রুচি, ব্যক্তিকে উল্লেখ করে প্রকাশ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি কেনো? আপনারা কি ভুলে যান আপনারা হাজার হাজার মানুষের অনুসরণের ব্যক্তিত্ব, ফেসবুকটা আপনাদের বেডরুম না? আপনাদের সামাজিক অবস্থানের কারণে একটা সামাজিক দায়িত্ববোধ আছে। সেই বোধ থেকে ব্যক্তিগত নেতিবাচক অনেক কিছু প্রকাশ্যে আনা ঠিক না। এর কারণে আপনাদের সমগোত্রীয় সবাই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। শুধু ব্যক্তিই না, নারীবাদের পুরো আদর্শটাই বিতর্কিত হয়ে ওঠে আপনাদের মতো অসহিষ্ণু দায়িত্বজ্ঞানহীন গুটিকয়েক কিছু মানুষের জন্য। উল্লেখ্য আমার এ লেখায় নারীবাদী বলতে শুধু নারীদেরই বুঝতে যাবেন না, পুরুষ নারীবাদীরাও এ আলোচনার আওতাভুক্ত।
আদর্শ প্রতিষ্ঠার জায়গাকে ব্যক্তিগত রেষারেষির দ্বারা কলুষিত করাই হচ্ছে ব্যক্তির দায়িত্বহীনতা।
আপনাদের মতো মানুষদের প্রকাশ্যে একটা টু শব্দ করার আগেও দশ বার ভাবা উচিৎ সেটার প্রভাব সমাজে কতটা পড়বে? হীন মানসিকতা প্রকাশ করে নিজেদেরকে আর বিতর্কিত না করে আদর্শের জায়গাটাতে দায়িত্বশীল হয়ে উঠুন। সহনশীলতা দায়িত্বশীলতার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তিগত জিদ, হিংসা প্রকাশ্যে না এনে সহনশীলতার পরিচয় দিন।
জানি অনেকেই হয়তো ভাববে আমার মতো চুনোপুটি জ্ঞান দিতে আসছে! সেসব রাঘব বোয়ালরা আমার লেখাও হয়তো পড়বেই না। এই জায়গাটাতেও অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু আদর্শের দায়িত্বশীলতার কারণে দুর্গন্ধ না ছড়ানোর জন্য অনেক কিছুই বলি না। চুনোপুটি -রাঘব-বোয়াল নির্বিশেষে সকলের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধও আপনার ঘোষিত আদর্শের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটা মনে রাখবেন।
শেষকথা, হীন মানসিকতা প্রকাশ্যে এনে নিজেরা কামড়াকামড়ি না করে আপনার অবস্থানের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে উঠুন দয়া করে।