আফ্রিদা তানজিম মাহি... আহা!
আফ্রিদা তানজিম মাহি, এক উজ্জল জীবনের কি নিদারুন অপচয়! অসাধারন মেধা সম্পন্ন, মাত্র ২০ বছরের মেয়েটি নিজেকে হত্যা করেছে কিন্তু কেনো? জানা যায় মাহির সাথে তার মায়ের ভালো সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু জীবনের জন্য আরো অনেক সম্পর্ক থাকতে হয়, যেমন বন্ধুবান্ধব, প্রেমিক। মাহির বয়সী একটা মেয়ের বন্ধুবান্ধবের সাথে হৈচৈ করে সময় কাটানোর কথা, প্রেম-ভালোবাসায় ডুবে থাকার কথা, বাস্তবে না হলেও কল্পনায় সঙ্গীর সাথে ভালোবাসার ভেলায় ঘুরে বেড়ানোর কথা! মাহির জীবনে কি এসব ছিলো? সম্ভবত ঘাটতি ছিলো।
সার্বিক সুস্থতার জন্য মানুষ এবং প্রকৃতির সাথে সংযোগ, মিথষ্ক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদের সাথে কথা বলা, অন্যরা কি করে তা স্বচক্ষে দেখা, শোনা, সেই পরিবেশের গন্ধ নেয়া, উপলদ্ধি করা সবই মিথষ্ক্রিয়ার অংশ। এসবের ঘাটতি হলে জীবন ভারসাম্যহীন হয়ে পরে। কোনো কারণে মাহির জীবন কি ভারসাম্যহীন হয়েছিলো? জানি না! তবে মেয়েটি চমৎকার এবং অর্থপূর্ণ সব ছবি একেঁ নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলো। কিন্তু তার চিত্রকলার মধ্যে একজন সদ্য তরুণীর উচ্ছলতা নেই, আকাঙ্খা, আনন্দ, স্বপ্নীল ভবিষ্যতের বার্তা নেই। বরং প্রতিটি চিত্রকর্মে বেদনা, বিমর্ষতা, বিষন্নতা, নির্যাতন এবং টিকে থাকার চেষ্টা। মাহি কি কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতায় রক্তাক্ত ছিলো? জানি না!
অনেক কারণেই একজন শিল্পী ছবি আকেঁন কিন্তু মাহির শিল্পকর্মগুলো দেখলে মনে হয় নিজের আবেগ প্রকাশের মাধ্যম হিসাবেই সে মূলত ছবি আঁকতো। যেমন, একটা ছবির শিরোনামই হচ্ছে ''অনুভূতির বিস্ফোরণ''। অন্য একটা ছবিতে দেখা যায় সানগ্লাস পরিহিত এক তরুনীর নাকটি লাল, কেউ শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলেই এমনটা দেখা যায়। আরেকটা ছবিতে দেখা যায় দুটো হাত নিষ্ঠুরভাবে একজন নারীর হৃদপিন্ড এবং নারীভুড়ি খামচে ধরেছে! চিত্রকলা কম্পর্কে আমার সীমিত জ্ঞানে এটা স্পষ্ট যে মেয়েটির জীবনে সুখের অভাব ছিলো। এমন কি ফেসবুকে দেয়া নিজের ছবিতেও তাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে।
পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং অবস্থানের কারণে একেকজন একেক কারণে বিমর্ষ হতে পারে যেমন: শারীরিক-মানসিক অত্যাচার, বিচ্ছেদ, প্রতারনা-বঞ্চনা'র শিকার, জীবনের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতা বা অপূর্ণতা, নিয়ন্ত্রিত হওয়া, অসহায়ত্ব, হতাশা, ভয়-ভীতি, দীর্ঘ অসুস্থতা, স্বজনের মৃত্যু, অভাব-অনটন, মর্যাদাহানি ইত্যাদি।
বোধগম্য কারণে আমাদের দেশে অধিকাংশ মেয়ে মনোকষ্টে ভুগে কারণ মেয়েরা কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ, ভয়, নিপীড়ন, লাঞ্ছনার মধ্যে বড় হয় এবং বসবাস করে। উপরন্তু 'মানিয়ে নেবার' নামে শিশুকাল থেকে মেয়েদের বঞ্চনা ও মানসিক যন্ত্রণা গোপন এবং দমন করার দীক্ষা দেয়া হয়। কেউ কেউ হয়তো মানিয়ে নিতে পারে এবং টিকে থাকে। কিন্তু সকলের অনুভূতি এবং ধারন ক্ষমতাতো এক নয়। ফলে অনেকের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনে জমাট বাধাঁ মনোকষ্ট, বিপর্যস্ত অবস্থা এক সময় বিষণ্ণতায় অথবা ক্রোধে রূপ নেয়। যখন একজন ব্যক্তি নিজের অসহায়ত্ব অতিক্রম করার কোনো উপায় খুঁজে পায় না তখন সে হতাশ হয়ে পরে। বলা হয় অসহনীয় অসহায়ত্ব এবং হতাশা আত্মহননের অন্যতম কারণ।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন হতাশা, ক্রোধসহ অনান্য নেতিবাচক আবেগ সামলাতে সহায়ক। খাদ্য গ্রহণ ব্যতীত শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্য পাচঁটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ এবং তা হচ্ছে:
১. ঘুমানো, ৭-৮ ঘন্টা;
২. মুক্ত বাতাস গ্রহণ বা উন্মুক্ত স্থানে সময় কাটানো;
৩. নিয়ম করে শরীরে রোদ্র লাগানো, প্রতিবার ২০-৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ৩-৪ দিন;
৪. শরীর চর্চা করা, প্রতিবার ৩০-৪৫ মিনিট করে সপ্তাহে ৪-৫ দিন;
৫. মানুষের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা।
মাহির জীবনযাপনে কি এসব ছিলো? সম্ভবত না। কোনো ব্যক্তি যখন সবকিছুকে উপেক্ষা করে একটা নিদিষ্ট কাজে নেশাগ্রস্থ হয় তার মানে সেই ব্যক্তির কোনো সমস্যা হয়েছে, সেই কাজটি যত ভাল কিছুই হোক। সেই ব্যক্তির সাহায্য দরকার কিন্তু ব্যক্তিটি নিজে তা বুঝতে পারে না। এ বিষয়ে আশেপাশের মানুষগুলোর সচেতনতা দরকার এবং সাহায্যের হাত বাড়ানো দরকার। দুঃখজনকভাবে মাহির পাশে তেমন কেউ ছিলো না। মেয়েটা শান্তিতে থাকুক!