রফি হক

চিত্রশিল্পী. সম্পাদক, শিল্পপ্রভা।

আফ্রিদা

অন্য আকাশের মেয়ে আফ্রিদা। কুড়ি বছরও পেরোয় নি এই শিল্পী! অথচ যাত্রা করলো অনন্তলোকে! ওর পেইন্টিংগুলির দিকে চেয়ে ছিলাম কয়েকদিন! বোকা মেয়ে। এমন প্রতিভা নিয়ে কেউ মরে যেতে চায়? কয়েকদিন আগে, আমার বাইরে যাবার তাড়া। একটা আননোন নম্বর থেকে কল এলো। আমি রিসিভ করি নি। আবার করল। এবার কী মনে করে রিসিভ করলাম। মেয়েটি বললো, আমার এক্সিবিশনে আসতে হবে। লিখতে হবে.... আমি যাকে চিনি না, আগে পরিচয়ও নেই। দেখাও হয় নি। তার কথা বলার ভঙ্গি ও অধিকারের ধরণ অনুভব করে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। আমার আর এক্সিবিশনে যাওয়া হয় নি। ওর মৃত্যুর পর ওর কাজগুলি দেখার পর মনে হলো….ওর কথা বলার ওটাই যথার্থভঙ্গি ছিলো। আত্মহত্যা মানুষ কী হঠাৎ করেই করে? অকস্মাৎ? চিকিৎসা বিজ্ঞান কিন্তু তা বলে না। একটা প্রক্রিয়া থাকে। প্রস্তুতি থাকে। থাকে কি?

২.
সিলভিয়া প্লাথও তাঁর জীবন থামিয়ে দিয়েছিলেন ত্রিশ না পেরোতেই! তাঁর জীবনের আরাধ্য ছিলো মৃত্যু। মৃত্যুর জন্য যিনি সাধনা করতেন, সেই তিনিই লিখেছেন, “...কখনো পারব কি, এই যে এত বই; সব পড়ে শেষ করতে? ইচ্ছে তো খুব, একার মধ্যে বহু হয়ে থাকার; জীবন কাটাবো যখন যেভাবে খুশি। সাধ হয় সবকিছুতে পটু হতে, সাধ্য নেই। বাঁচতে ইচ্ছে করে। সব রং, আলো, ছায়া, রস, রূপ, সুরভি নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে।...”

৩.
আফ্রিদা ফ্রিদা কাহলোতে নিমগ্ন ছিলো। ফ্রিদা কাহলোর সঙ্গে আফ্রিদার পেইন্টিংটি অপূর্ব। জোড়া ভ্রুর ফ্রিদা কখন যে আফ্রিদার সত্তায় হানা দিয়েছিলো—আর তাই ফ্রিদাও আফ্রিদা হয়ে গিয়েছিলো। এত যে নিমগ্ন ফ্রিদায় আফ্রিদা—সেই ফ্রিদাও বেঁচেছিলো তীব্র আকাঙ্ক্ষায়, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। কী নিদারুণভাবে বেঁচে থেকে কালজয়ী সব পেইন্টিং করে গেছেন। ফ্রিদার জীবন লড়াই, বেঁচে থাকা, শিল্পী হিসেবে নিজেকে সোরগোল করে প্রতিষ্ঠিত করা…. রুগ্ন শরীর নিয়ে চলাফেরা করতে না পারার করণে পালঙ্কে শুয়ে নিজের প্রদর্শনীতে উপস্হিত থাকা….এই সবকিছুর ভিতরেই আছে ফ্রিদা জেদী মনোভাব। যা তাঁকে কখনও জীবনের কাছে হার মানতে দেয়নি। কী তীব্রভাবে জীবনের শেষ নির্যাসটুকু নিয়ে ফ্রিদা বেঁচেছেন। এ যে কারোর জন্য ভীষণই অনুপ্রেরণার। আফ্রিদা নিশ্চয়ই ফ্রিদাকে ভালোবাসতো, আফ্রিদা কেবল ভালোবাসে নি নিজেকে!

সিলভিয়া প্লাথের ডায়েরির এক জায়গায় আছে : “...কেউ কি আছো কোথাও, যে আমাকে একটুও বুঝতে পারো, একটুও ভালোবাসো?”

আফ্রিদারও সিলভিয়ার মতো এমন কোনো অর্ন্তদহনের আকুতি ছিলো কিনা জানি না।

তবে একটি কথা কী... জীবন সর্বদা লড়াইয়ের। প্রতিভার বিকাশও লড়াই করে করতে হয়। শিল্পী কবিদের জীবন আরও দুর্ধর্ষ। কত বিষ যে গিলতে হয়! তবু এক দিনের জন্য থেমে যাওয়া যা্বে না। একদিন থেমে যাওয়া মানে একদিন অন্যদের থেকে পিছিয়ে যাওয়া। আর ক্রিয়েটিভ মানুষদের বেশিদিন বাঁচতে হয়। রবীন্দ্রনাথ যদি এতদিন না বাঁচতেন? আমরা কত কিছু হারাতাম। কত কিছু থেকে বঞ্ছিত হতাম!

৪.
পিকাসো, মাতিস, সালভাদর দালী, হুয়ান মিরো, ডি কুনিং, সাই টম্বলি... এরা প্রত্যেকে গড়ে ৯০ বছরের আয়ু পেয়েছেন। এরা পুরো আর্টের পৃথিবীটিই পরিবর্তন করে দিয়েছেন। আধুনিক আর্টের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছেন। অনেকে নোবেল পান না কম আয়ুর কারণে। ভাবুন আমাদের জয়নুল, সুলতান, কামরুল হাসান, সুফিয়া কামালের কথা। এঁদের কারো জীবন নিষকন্টক ছিলো না। তাই হুম করে চলে যাওয়া কোনো কাজের কথা নয়। তরুণদের বলি। কোনো পরিস্হিতিতেই আপনারা মনোবল হারাবেন না। লেগে থাকা আর লড়াই করার বিকল্প কিছু নেই। এই দুটি এলিমেন্ট ছাড়া মেধা মূল্যহীন। ক্রিয়েটিভ প্রসেসের মধ্যদিয়ে ভ্রমণে বেঁচে থাকা এক অন্য আনন্দের। অভিমান খুব মূল্যবান। আবার অভিমানের মতো খারাপ নষ্ট অসভ্য অভিব্যক্তি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই! কার ওপর অভিমান করবেন? যে আপনাকে বুঝে না? অভিমানের বুকে লাথি মেরে বাঁচুন। ছবি আঁকুন। গান করুন। কবিতা লিখুন। বাঁশি বাজান, ডায়েরি লিখুন, সুকুমার যা যা মনে চায় তাই করুন। প্রয়োজনে দূরে চলে যান। একা থাকুন। কিন্তু বাঁচুন।

আফ্রিদার মমতাময়ী মা মুন্নী আপা কীভাবে এই শোক সামলে উঠবেন জানি না। তাঁর জন্য গভীর সমবেদনা।

1877 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।