লাবণী মণ্ডল

নারীবাদী লেখিকা।

এ সমাজ লাভলীদের নয়

দু'দিন ধরেই ফেসবুকে লাভলীর নামটি দেখতে পাচ্ছি। লাভলী ইডেন মহিলা কলেজে পড়েন। মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী। তার প্রেমিকের পিঠে চাকু বসিয়ে দিয়েছিলেন দু’দিন আগে, উদয়ন স্কুলের সামনে। নিউজটা দেখছিলাম, চোখ এড়িয়ে যায় নি। কি করবো, কি লিখবো, কি ভাববো! বুঝে উঠা মুশকিল। কেনো কাজটি করলো লাভলী! আচ্ছা, লাভলী কি অসুস্থ, পাগল? আমি কিন্তু লাভলীকে পাগল বলতে পারছি না। এত সহজে সমীকরণ টেনে দিতে পারি না। 

দীর্ঘ দিন ধরে প্রেম করছিলো আল আমিনের সাথে। প্রেমিকের পেশা প্লাস্টিক ব্যবসায়ী। প্রেম থাকাবস্থায় তাদের দু’জনের বিয়ে হবে বলে কথা হয়। তাদের দু’জনের মতের ভিত্তিতেই শারীরিক সম্পর্কও হয়। কিন্তু, আল আমিন এখন আর বিয়ে করতে রাজি নয় লাভলীকে। 

এটা নিয়েই তাদের বেশ ক’দিন ধরে তর্কবিতর্ক চলছিলো। যেদিন ছুরি মেরে দেন আল আমিনের পিঠে সেদিনও এ নিয়েই তর্ক চলছিলো। ব্যাপারটা মোটে ছোট নয়, হাস্যকর নয়, স্যাটায়ার করে এড়িয়ে যাবারও কিছু নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লক্ষ লক্ষ নারীরা এইভাবে আশাহত হন। তাদেরকে প্রেম করার সময় হাজারো প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোগ করা হয়। কিন্তু, এক পর্যায়ে পুরুষগুলো নারীদের সাথে প্রতারণা করে। নারীরা প্রতারিত হয়। 

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, নারীরা কি প্রতারণা করে না? তারা কি অন্যকোথাও বিয়ে করে না? হ্যাঁ, করে।উদাহরণ সবসময় বেশিভাগটা দিয়ে হয়। যেমন: লাভলী ছুরি বসিয়ে দেওয়াটা উদাহরণ টেনে সকল নারীদের অপদস্থ করার মানে হয় না। লাভলী এই প্রেমিককে যা করেছে তা ৯৯% নারী করে না। কিন্তু ৯৫% পুরুষই এটা করে থাকে। 

আর হ্যাঁ, কতটা রাগ হলে এ কাজটা করতে পারে! রাস্তায় দাঁড়িয়ে? লাভলীকে নিয়ে ট্রল করার কিছু নেই। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হবে। ওই প্লাস্টিক ব্যবসায়ীর সম্পর্কে খোঁজ নেওয়াটা জরুরি। খুব জরুরি ।স্পষ্টভাবে নারীসমাজকে বুঝতে হবে এই পুরুষতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী সমাজ নারীকে ভাবে না। নারীকে ঠিক যতটুকু প্র্রয়োজন ততটুকুই ব্যবহার করে। নারীর যৌনাঙ্গকে পণ্য বানায় এই সমাজ। সুতরাং, বুঝতে হবে এটাকে ইসুৎ করে পুরুষ মনস্তত্বের লোকরা যাতে যা খুশি তা বলতে না পারে লাভলীকে। 

আর একটা বিষয়, লাভলী যখন বুঝতে পারলো এই ব্যবসায়ী তাকে আর চায় না, তার কাছে তার প্রয়োজন শেষ। তখন তাকে থুথু দিয়ে চলে আসা। এটা কঠিন। তবেই এটাই করতে হবে। আত্মসম্মানবোধ নিয়ে ভাবতে হবে নারীকে। ভালোবাসি বলে আমার আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিতে রাজি হবো না।

যখন আল আমিনরা মুখ ঘুরিয়ে নেয় তখন ঘুরিয়েই রাখতে দিতে হবে। আল আমিনদের ধিক্কার দিতে শিখতে হবে। ভালোবাসা থাকলে তো আলআমিন বিয়েতে রাজি হতো। আল আমিনের চিন্তাটা ছিলো লাভলীকে বিয়ে না করে যা করা যায়। এই যে চিন্তাটা এটা বোঝার দায়িত্ব লাভলীদের। সাথে নিজেরা চিন্তা করতে শিখতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য চেষ্টা করতে হবে।

একজন মাস্টার্স পড়ুয়া ছাত্রী তো অনেক বোধবুদ্ধি থাকার কথা। কিন্তু সেই বোধবুদ্ধি লাভলীর ভিতরে জন্ম নেয় নি। এটা বুঝতে হবে। বিচক্ষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে এ ধরনের আচরণ করে না। এটা শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। লাভলীদের মনে এরকম বহু আগুন। যে আগুন বিস্ফোরিত হলে আল আমিনরা ভস্মীভূত হবে। পুড়ে ছারখার হবে, মানুষ হবে। 

আমি লাভলীর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। এই লোকটির অনেক পরিচিত রয়েছে। যারা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে লাভলীর ক্ষতি করতে পারে। লাভলীকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হবে। আরো দৃঢ়ভাবে, শক্তিশালীভাবে। বুঝতে হবে এ সমাজে আল আমিনদের সংখ্যা বেশি। এই সমাজটা ওদেরই। ওরাই পরিচালনা করে এ সমাজ। কোথায় নিরাপদে আছে নারী? পৃথিবীর কোনো প্রান্তে? কোথাও না। যারা এই ইস্যুৎকে কেন্দ্র নারীসমাজকে খুনি বলে আখ্যায়িত করছেন তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

3082 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।