জেনোসাইড নিয়ে পড়ালেখা, আলাপ আলোচনা, জেনোসাইড ভুলে না যাওয়া জরুরি কেনো- একরামুল হক এর হত্যার অডিও তার একটা উদাহরণ হতে পারে।
মানব ইতিহাসের হাতে গোনা দু’একটা ভয়ংকর জেনোসাইডের একটির উপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। না, আমি সংখ্যার তর্কে যাই না- জেনোসাইড স্টাডি সংখ্যার বিতর্ক এড়িয়ে যায়। নৃশংসতার ঘনত্ব, ধরন, উদ্দেশ্য এসব মিলিয়েই '৭১ এর জেনোসাইড মানব ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর।
অনেকেই সমালোচনা করছেন, শুধু এই অডিও শুনার পর সবাই কেনো প্রতিবাদী হচ্ছেন, যেগুলোতে অডিও শুনা যায় নি সেগুলোতে প্রতিবাদ হয় নি কেনো? এই অডিও একটা প্রতীক যা সরাসরি মানুষের নার্ভের উপর আঘাত হেনেছে।
এবার '৭১ এর জেনোসাইডের যে অভিজ্ঞতা- সেটা আমরা কতোটুকু জেনেছি সরাসরি ভিক্টিম কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে? মুক্তিযুদ্ধ মানে কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব গাঁথা নয়, জেনোসাইডের শিকার- জেনোসাইডের প্রত্যক্ষদর্শী মানুষদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাও এর উপাদান। একরাম হত্যার অডিও র মতো এই অভিজ্ঞতাগুলো সামনা সামনি শুনলে, নার্ভের উপর একই রকম চাপ পড়তে বাধ্য।
1971Archive আর্কাইভের কাজ করতে গিয়ে আমাদের নার্ভের উপর এই চাপ পড়ে বারবার। ৪৭ বছর গত হয়েছে তাতে কী? একরামের সন্তানেরা বেঁচে থাকলে আরো ৪৭ বছর পরে ও একই আতঙ্কে কুঁকড়ে উঠবে।
কিশোরগঞ্জে একজনকে পেয়েছি- কিশোর ছিলেন তখন, বাবা কাকা ভাই সহ পরিবারের আরো ছয়জন পুরুষের সাথে তাকে বেঁধে নেয়া হয়েছে বধ্যভূমিতে। তাকে হত্যা করা হয় নি, কিন্তু তাকে বাধ্য করা হয়েছে দেখতে, চোখের সামনে সবাইকে বাঁধা হয়েছে- গুলী করা হয়েছে, তারপর ঘাতকেরা তাকে পরবর্তী স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। সেই কিশোর, আজকের প্রায় বৃদ্ধ মানুষটা কি জীবনের কোনো একদিনের জন্য গুলীর আওয়াজ, স্বজনের শেষ চিৎকার ভুলতে পেরেছেন?
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর বাজারে ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান দিবসে হিন্দুদের দিয়ে অনুষ্ঠান করিয়েছে সন্ধ্যা বেলা, রাতের বেলা বাজার ঘেরাও করে ১৪৬ জন নারীপুরুষকে লাইন ধরে বেঁধে নিয়ে হত্যা করেছে নদীর পাড়ে। একজন নারী আট মাসের অন্তঃস্বত্বা ছিলেন, গলা দিয়ে গুলী ঢুকে ঘাড় দিয়ে বের হয়ে গেছে। না তিনি মারা যান নি, নদীতে ভেসে ভেসে অন্য গ্রামে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিলেন। দু’মাস পর তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে, প্রতিবন্ধী। রক্ত শূন্যতার কারণে। হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না, আঠারো বছর ধরে ভাত খায় না- মা বাবার উপর রাগ করে।
গত ৪৭ বছর ধরে এই প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে বেঁচে আছেন সেই দম্পতি, তারা মরে গেলে কী হবে?
আমরা যদি ন্যুনতম কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন, বিবেকবান জাতি হতাম- জেনোসাইডের এই ঘটনাগুলো আমরা ভুলে যেতাম না, এড়িয়ে যেতাম না। আমরা উপলব্ধি করতাম, আমরা শিক্ষা নিতাম। আমাদের নীতি, নৈতিকতা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা সব কিছুতে এই সংবেদনশীলতা থাকতো।
এই সংবেদনশীলতা শুধু রাজনীতি নয়, শুধু পাকিস্তান আর্মির অক্সিলারী ফোর্সের বিচার নয়- এই সংবেদনশীলতা নিশ্চিত করতো এই মাটিতে আর কোনোদিন কোনো জেনোসাইড নয়, দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার নয়, এই মাটিতে আর কোনোদিন কোনো অজুহাতেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড নয়।
এতো রক্ত, এতো আত্মত্যাগের এই দেশ- এমন হবার কথা ছিলো না, এমন হবার কথা নয়!