‘নারী দিবস ২০১৮’ এর প্রতিপাদ্য-
“সময় এখন নারীরঃ উন্নয়নে তারা
বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরে কর্ম জীবনধারা”
'উন্নয়নে নারী', ‘নারী উন্নয়ন’, নাকি 'নারীর জন্য উন্নয়ন' তাই নিয়ে তর্ক-বিতর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু এদেশে 'উন্নয়ন’ এবং ‘নারী'’, এই শব্দদুটো বললেই নিঃসন্দেহভাবে গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত নারীদের চিত্র মনে আসে।
অনেক বছর আগে আমার নতুন জামা দেখে বন্ধুদের একজন ঠাট্টা করে 'গার্মেন্টসের মেয়েদেরে মতো জামা' বলাতে অপমানে কেঁদেছিলাম আমি। অপমানটা ঠিক যে 'গার্মেন্টস এর মেয়ে' শব্দটার জন্য লেগেছিলো তা নয়, কথাটা বলায় মিশে থাকা তাচ্ছিল্য বন্ধুর কাছে প্রত্যাশিত ছিলো না বলে কেঁদেছিলাম। কিন্তু এখন ভাবি, কেনো আমার মনে হয়েছিলো কথাটাতে তাচ্ছিল্য আছে? অবচেতনে আমি জানতাম 'গার্মেন্টস এর মেয়ে' তুচ্ছার্থে উদাহরণ হিসেবে টানার মতোন কেউ, তাই তো? নিজের মনেই লজ্জা হয় ভেবে। এই কথায় এখন আর অপমানবোধের প্রশ্নই আসে না। গার্মেন্টস কর্মীদের নিয়ত সংগ্রাম, ওদের প্রাণচাঞ্চল্য, ওদের রঙিন জামা, ওদের পরিশ্রম, জীবনের স্বাদ নেওয়া- সবই এখন মুগ্ধ করে আমাকে!সকালবেলা দল বেঁধে ওদের কাজে যাওয়া দেখে আমার মন ভালো হয়ে যায় বললে অনেকে্র হয়তো হিপোক্রিসি/ভন্ডামি/ভাবনা বিলাস মনে হয়তে পারে। ওদের বাস্তবতায় এই চলার পথে কতো সংগ্রাম আছে জানি, মানিও এ সমাজে এই সংগ্রামের রূপ কতো ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু এটা সত্যি যে গার্মেন্টস কর্মীদের সাহস আর জীবনযুদ্ধ আমাকে এক রকম প্রেরণা যোগায়। ওঁদের অসম্মান করে কেউ কোনো কথা বললে এখনো আমার খুব লাগে; নিজের নয়, ওদের হয়েই লাগে গায়ে। উপলব্ধির জগৎটাতে আমার এই পরিবর্তন আমি টের পাই।
২০১০ সাল। তখন রংপুরে কাজ করি একটা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায়। আমার বাড়ি চট্টগ্রাম বলে মাঝে মাঝেই নন-এসি বাসে রংপুর থেকে চট্টগ্রাম আসা যাওয়া করতাম তিনদিনের ছুটি পেলেই। পকেটে টাকার পরিমাণ যা-ই হোক, সরাসরি যাতায়াতের জন্য বাহন ওই একই। সুতরাং সেই বাসে নানা ধরনের মানুষের যাতায়াত। সেরকমই একটা যাত্রায় আমার পরিচয় হয় শাপলার সাথে। আমি বাড়ি থেকে ফিরছিলাম, আর ও বাড়ি আসছিলো। ওর বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুরে। কাজ করে চট্টগ্রামের কোনো গার্মেন্টসে। সারাটা পথ আমি ওর গল্প শুনেছি। ওর নিষ্ঠা, ওর দায়িত্ববোধ, সংগ্রাম, কাজ করার তৃপ্তি, হতাশা- সব শুনেছি সারারাত। নিজের জীবনটা ধরে রাখতে, যৌন নির্যাতন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে নানা কৌশল অবলম্বনের কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়েছে।
শাপলার বয়স তখন ২৫। ক্লাস নাইনের পড়া ছেড়ে দিয়ে তারপর থেকে গার্মেন্টসে কাজের শুরু। ছোটোভাই-বোনদের দায়িত্ব নিতে ‘বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত’ ধরে রাখতে ওর কতো কঠিন পথ যেতে হয়েছে, আবার এখন চাকরীটা ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ায় কেমন অদ্ভুত রকমের ক্লান্তি, ভীতি, অনিশ্চয়তা আবার ভালোলাগায় মেশা অনুভূতি- সে কথা বলছিলো সে। ভোর বেলা বাস থেকে নামার আগে আমাকে ওর বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। ফোন নাম্বারটা এখনো আছে আমার কাছে। মাঝে মাঝে চেক করি। দেখতেও ভালো লাগে যে নাম্বারটা আছে। ফোন দেই না। ও নিশ্চয়ই ভুলে গেছে আমাকে।
একবার কোনো এক লেখায় গার্মেন্টস কর্মীদের সম্মান করার বিষয়ে তর্ক উঠলো। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো কেউ কারো দিকে- খুব তো সম্মান করেন বলছেন, নিজে কোনোদিন গার্মেন্টসে কাজ করবেন? নিজের ভাইয়ের সঙ্গে গার্মেন্টস কর্মীর বিয়ে দিবেন? নিজের ছেলের সঙ্গে? আপনার বোনকে গার্মেন্টসে কাজ করাবেন ঐ বেতনে?
প্রশ্ন বেশ কড়া এবং জ্বালাময়ী। কিন্তু আমার দিক থেকে উত্তরটা একেবারেই নিরীহ। করবো না গার্মেন্টস শ্রমিক হিসেবে কাজ। কারণ আমার দেখার পথটা, আমার গন্ডিটা আরো প্রসারিত ছিলো। আমি চেয়েছি নিজের গন্ডি ভাঙতে, ভেঙেছি। শাপলাও তাই করেছে। ও আমার মতো বেতন পায় না, কিন্তু যা পায় তার জন্য ওর সংগ্রাম, আর আমি আজকে যা পাই তার জন্য যে পথ আমি পাড়ি দিয়েছি- তুলনা হয়তো হয় না কোনোটা কম কোনটা বেশি; কিন্তু মূল বিষয়টা একই। শাপলা তো আমার বাস্তবতায় বেড়ে ওঠেনি। ও ওকে ছাড়িয়ে বাইরে বের হয়েছে, আমি আমাকে। গন্ডি ভাঙার স্বপ্নটাও যার যার বাস্তবতা থেকেই দেখেছি। আর বিয়ে? আমি বিশ্বাস করি সিদ্ধান্ত এবং তার দায়ভার যখন যার যার তার তার, তখন অন্যের জীবন নিয়ে মাথা ঘামানোর যেমন প্রয়োজন হয় না, তেমনি একের সিদ্ধান্তের ফলে অন্যের ভোগান্তির সুযোগটাও কমে আসে। সুতরাং এ ধরনের প্রশ্ন আমার কাছে অবান্তর। বিষয়টা হলো মান-অপমানের বোধ বিভিন্ন ছুতোয় আমরা পরিচয়ে-পোশাকে-পেশায় জড়িয়ে রেখেছি। অথচ এই বোধ হওয়া চাই গড়ে ওঠার পথের, মননের, মানুষ-জীবন যাপনের ধরনে। এক্ষেত্রে দিন শেষে আমাদের এখন প্রয়োজন হলো যে যেখানেই আছে তার সাথে ‘শ্রেণীগত’ বিদ্বেষ/বিভেদ থেকে অসম্মানের যে চর্চা সেটা থেকে বের হবার প্রচেষ্টা।
গার্মেন্টস শ্রমিক বলতে নিউজ পেপারে আসে কারখানায় সারি সারি সেলাই মেশিনের সামনে কাজ করতে থাকা কৈশোর আর তারুণ্যের সময় পার করা মেয়েদের ছবি। কিন্তু আমি এর বাইরে আরো অনেক অনেক ছবি দেখি। শিশু বিয়ের কবল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে দূর শহরে পাড়ি জমানো দুঃসাহসী মেয়েটাকে দেখি, নদীভাঙা পরিবারের খাওয়া-পরার দায়িত্ব নেওয়া মেয়েটাকে দেখি, ব্যবসায় ধ্বসে পড়া ভাইটাকে ঋণগ্রস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য জীবন বাজি রাখা মেয়েটাকে দেখি, ছোটো ভাইবোনকে শিশুশ্রম থেকে বাঁচিয়ে স্কুলে পাঠানোর জন্য যৌন নির্যাতন সহ্য করেও দাঁত কামড়ে চাকরী করে যাওয়া মেয়েটাকে দেখি, মাঝরাতে উঠে রান্না করেও সারাদিন নিরন্তর কাজ করা মেয়েটাকে দেখি, একাধিক ব্যক্তির যৌন নির্যাতন ঠ্যাকাতে কোনো এক ব্যক্তির নির্যাতনে সমঝোতা করা মেয়েটাকে দেখি! আবার দল বেঁধে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া রঙ্গীন ঝলমলে মেয়েটাকে দেখি, একটুখানি ছুটির আনন্দ সিনেমা দেখে চেখে নেয়া মেয়েটাকে দেখি, প্রেমে পড়ে জীবনটাকে উদ্বেল করার স্বাধীনতা পাওয়া মেয়েটাকে দেখি, নিজের পয়সায় নিজের জীবন তৈরি করা মেয়েটাকে দেখি, পরিবারের জন্য নিজেকে ছাড়িয়ে দূর থেকে দূরে ছড়িয়ে যাওয়ায় তৃপ্ত মেয়েটাকে দেখি! এদের প্রত্যেকের জীবনীশক্তি আমাকে মুগ্ধ করে, অনুপ্রেরণা যোগায়।
নারীর জন্য এখনো সময় বন্ধুর, তবু এই যাত্রাপথের প্রতিটি সংগ্রাম সুন্দর। ঘুরে দাঁড়ানো, ফুঁসে ওঠা, পথে বিছানো কাঁটা মাড়িয়ে ছুটে চলা দুর্বার, ছড়িয়ে যাওয়া গ্রাম-শহর-দেশ-বিদেশ-পথে প্রান্তরে-মাঠে-কাজে-অকাজে-আনন্দে-বিনোদনে, সুন্দর!