লাবণী মণ্ডল

নারীবাদী লেখিকা।

৭১-এর বীরাঙ্গনা ৭১ বছর বয়সে বিদায়

২০১৪ সাল। বইমেলা চলছে। শব্দশৈলীর পাশেই আমাদের ‘বিপ্লবীদের কথা’র স্টল। পাশেই বসা প্রিয় ‘ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী’। তখনও তাঁর নামটির সাথে ওইভাবে পরিচিত না। টুকটাক জানি আর কি! তাঁকে ঘিরে পাঠক-ক্রেতাদের ব্যাপক উল্লাস। কিছু বুঝে উঠতে পারি নি তখনও। হঠাৎ করেই একজন এসে বললেন- ‘নিন্দিত নন্দন’ আছে? না। 

উনি ফিরে যাওয়ার সময়ই কে যেন ইশারায় বললেন পাশেরটা পাওয়া যাবে। তখন তাঁকে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়। ‘নিন্দিত নন্দন’ বইটি উল্টিয়েপাল্টিয়ে দেখি। বইটি মূলত তাঁর আত্মজৈবনিক। মুক্তিযুদ্ধের দুবির্ষহ দিনগুলোর কথা তুলে ধরেছেন। এই ছিলো কাছ থেকে তাঁকে দেখা। সেদিন তাঁকে ছুঁয়ে দেখি নি, হয়তো অপরিপক্ক ছিলাম। এরপর থেকে নানানভাবে কর্মের মাঝে তাঁর সাথে পরিচয়।

আমাদের বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আছে। এবছরটা একাজে অনেকটা সময় ব্যয় করবো বলেও আশা করছি। প্রিয় শ্রদ্ধেয় প্রিয়ভাষিণীও আমাদের কাজের অংশ ছিলো। আজ ছিলোই বলতে হচ্ছে। কেননা, ৭১ এর বীরঙ্গনা ৭১ বছর বয়সে দৈহিকভাবে বিদায় নিলেন। 

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে নিয়ে করা কয়েকটি ডকুমেন্টারী আজই দেখে ফেললাম। এর আগে দেখা হয় নি। ‘মানুষে’র এটাই হয়তো বিশেষত্ব। তাঁর চলে যাওয়ার পরই তাঁকে নিয়ে জানার আগ্রহটা তীব্র হয়। এটাই তাঁর সার্থকতা অর্থাৎ একজন কীর্তিমান ‘মানুষে’র সার্থকতা। মানুষ বেঁচে থাকে কর্মের মাঝে। ‘মানুষ’ শব্দটির পরিপূর্ণতা পায় তাঁর কর্মচরিত্রের মাঝে। আমাদের সবার প্রিয় ঠিক বেঁচে থাকবেন কর্মচরিত্রের মাঝে।

যাহোক, প্রিয়ভাষিণীর একটি ডকুমেন্টারী দেখে শুধু আপ্লুত হয়েছি, তিনি বলছেন- ‘আমি অবহেলিত কাঠ, শিকড়, বাঁকড় নিয়ে কাজ করি আর ভাবি আমার জীবনটাও এরকম অবহেলিত।’ কতটা মর্মান্তিক কথা! একজন বীরাঙ্গনা, একজন সৃষ্টিশীল মানুষ কতটা আঘাতপ্রাপ্ত হলে, সমাজ সম্পর্কে কতটা ঘৃণা থাকলে এরকম কথা বলতে পারেন? তাঁর জীবনটাকে মিশিয়েছিলেন প্রকৃতির সাথে। প্রকৃতিই যেন তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিলো। প্রকৃতিকে ভালোবাসেই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের টানিং মুহূর্তগুলোকে। 

যুদ্ধাপরাধী বিচার সম্পর্কে, প্রিয়ভাষিণী বলেছেন- ‘আমরা যুদ্ধের দিনগুলোর কথা ওভাবে বিশ্লেষণ করতে চাই না, করলে হয়তো আপনারা বিশ্বাসও করবেন না! কতটা ভয়ংকর ছিলো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। কিন্তু বিচারটা এরকম চাই না যে, রাতে-আঁধারে দু’একজনের বিচার করলেন। বাকিরা বেঁচে গেলো। গোলাম আজমকে বাঁচিয়ে রাখা গণতন্ত্রের মধ্যে পড়ে না। এটা কে গণতন্ত্র বলে না।….’ স্পষ্টভাবেই তিনি পাকিস্তানী পৃষ্ঠপোষকদের বিচার চেয়েছেন এবং বলেছেন ‘পবিত্র সংসদে তাদের মতো বন্য জানোয়ার কিভাবে প্রবেশ করে?’ এটা প্রিয়ভাষিণীদের জন্য খুবই কষ্টের ছিলো। এর চেয়ে কষ্ট তাঁদের জীবনে আর নেই।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী একজন মানুষ। একজন শিল্পী। একজন বীরাঙ্গনা। একজন যোদ্ধা। ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ডাক বাংলোর মোড়ে। তাঁর নানা ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী। তাঁদের নানার সেই বাড়িটির নাম ছিলো ফেয়ারি কুইন বা পরীর রানী। প্রকৃতিকে জীবনের সঙ্গে এক করে ফেলার যে বিশাল যোগ্যতা তা তিনি পেয়েছিলেন শিশু বয়স থেকেই। ১১ ভাই- বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। মা-বাবার সম্পর্কের নানান জটিলতায় প্রিয়ভাষিণী জর্জরিত ছিলেন। ১১ ভাই-বোনের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে বর্তায়। 

মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন। ১৯৭১ সালে সংসার জীবনের মাত্র ৮ বছরের মধ্যেই তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৭১ সাল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে সন্তানাদি নিয়ে ভয়ংকর জীবন অতিবাহিত করা শুরু করেন। পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন। এক দুবির্ষহ জীবন পার করতে হয়েছে তখন তাঁকে। 

পরিবারের সদস্যরা অনেক বেশি শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা করলেও এই পাক হানাদার নির্যাতনের কারণে প্রিয়ভাষিণীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। যেটা তাঁর জন্য এক ভয়ংকর কষ্টের। 

১৯৭২ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্বামী আহসান উল্লাহ সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তারপরও মাঝেমধ্যেই এসববিষয় নিয়ে তাঁদের মাঝে বাকবিতন্ডা হতো। তাঁকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যেত অপারগ প্রকাশ করতেন এবং নিজেও নিরুৎসাহিত করতেন। তারপরও তাঁর স্বামীর অনুপ্রেরণায় এবং নিজের প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির ফলেই আজ তিনি ভাস্করশিল্পী। তাঁর ভাষ্যে, ‘ভাস্কর শিল্পী হওয়ার জন্য আমি শিল্প চর্চা করি নি। কখন কিভাবে এত কাজ করে ফেলছি তা নিজেও বুঝে উঠতে পারি নি।’ এটাই একজন শিল্পীর কাজ হওয়া উচিত। যখন কোনো শিল্পী নিজেকে ‘শিল্পী’ মনে করে ফেলে তখনই তার শিল্পসত্তার মৃত্যু ঘটে। এটা জীবনের সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

প্রকৃতির নিয়ম ‘মৃত্যু’ অনিবার্য। সুতরাং, মানুষকে মরতেই হবে। একমাত্র মৃত্যৃর কাছেই একজন মানুষের পরাজয় মেনে নেওয়া উচিত। আমাদের প্রিয় ফেরদৌসীও এর বাহিরে ছিলেন না। প্রকৃতির নির্মমতাকে জয় করতে না পেরেই তিনি আজ দৈহিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। 

কিন্তু এটাই শেষ নয়। এখান থেকেই যেন শুরু। নতুন করে পাঠ করার শুরুটা হোক। হাজার হাজার প্রিয়ভাষিণীদের গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কারণেই আজ আমাদের বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ একটা পতাকা পেয়েছে, একটা মানচিত্র পেয়েছে। সেই বাংলাদেশকে কালো দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করাই আমাদের দায়িত্ব হোক। এখানে বটবৃক্ষের মতো ছাঁয়া দিয়ে পাশে থাকবেন হাজার হাজার প্রিয়ভাষিণী। শোককে শক্তিকে পরিণত করেছিলেন আমাদের ‘আম্মা’। আমরা কেনো পারবো না! 

একজন মানুষ কতটা জনপ্রিয় হলে ‘আম্মা’ ডাকটি শুনতে পান। পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর এবং গুরুত্ববহ এই শব্দটি। আমাদের এই সময়ে শ্রদ্ধেয় প্রিয়ভাষিণীদের বড়ই অভাব। শুধু অভাবই নয়, নেই বললেই চলে। পুঁজিবাদের ভয়াল আগ্রাসনে আজ সম্পর্কগুলো সবই বাজার অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। তারপরও এঁরাই আমাদেরকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগান। 

আমাদের মাঝে শক্তি হয়ে বেঁচে থাকবেন তিনি। পুরো জাতির অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি নারীজাতির তিনি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। কত বীরাঙ্গণা নিজের মান-ইজ্জতের ভয়ে মুখ লুকিয়েছেন, তা আমাদের অজানা। তবে সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। তা আমরা বুঝতে পারি। প্রিয়ভাষিণী আপনি বেঁচে থাকবেন যতদিন এই মানবসভ্যতা টিকে থাকবে। আপনি আলো জ্বালাবেন যতদিন আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে না উঠবে। 
লাল সালাম ‘আম্মা’

1532 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।