নারী ডট নিউজ অনলাইন জার্নালে গত দু'মাস ধরেই বাংলাদেশের পৈশাচিক শিশু ধর্ষণ, হত্যা, নারী ধর্ষণ আর নারী হত্যা ইত্যাদি খবরে যখন বাতাসটা ভীষণ ভারী হতে শুরু করেছিলো, তখন প্রগতিশীল মানুষরা প্রচন্ড ভাবে জেগে উঠেছিলো, ব্লগে আর সোসাল মিডিয়াতে, একসময় মনে হচ্ছিলো জনগনের এই প্রতিবাদ শাসকগোষ্ঠীকে কোনোভাবেই নাড়া দিচ্ছে না, তারা এই অপরাধকে আমলে না নিয়ে, নিজেদের দুঃশাসন কে লুকিয়ে সেলিব্রেশন করা শুরু করলো, তোতাপাখির মতো বলেই চললো, দেশটা নাকি "উন্নতির জোয়ারে" ভেসে যাচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, আমরা নাকি মাথা প্রতি আয় বাড়িয়েছি, দেশটা উন্নতিশীল দেশে পরিণত হয়েছে।
সপ্তাহব্যাপী কোটি টাকা সরকারী অর্থব্যয় করে রাজনৈতিক দলের আনন্দ মিছিল আর র্যালী দেখলাম। ঠিক তেমনি এক সময়ে, ইউরোপের আমি যে দেশটায় থাকি সেই দেশে, জার্মানিতে দীর্ঘ ৫ মাস আগে হয়ে যাওয়া ভোটের পর, অনেক রাজনৈতিক আলোচনা আর সমঝোতার পর এক কোয়ালিশন সরকার গঠন হলো। আঙ্গেলা মের্কেল আবার সরকার প্রধান হলেন, তিনি জনগনের সেবার দুটি দলের কর্মসূচি একত্র করে গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠন করলেন। তাই দেশের শত নেতিবাচক ঘটনার পরেও একটা গনতান্ত্রিক দেশের ইতিবাচক খবরের জের ধরেই আবার আশায় বুক বাঁধি এইভেবে যে হয়তো বা কোনো একদিন আমরাও এমন করে একটি সুখী সুন্দর রাষ্ট্রব্যবস্থা চালাতে পারবো। তাই আজকের এই কম্প্যারেটিভ আলোচনা।
জার্মানির নুরুল ইসলাম নাহিদ এর নাম আনিয়া কার্লিচেক, এই ৪৬ বছর বয়সের চার্মিং লেডি হলেন আঙ্গেলা মের্কেল এর ক্যাবিনেটে শিক্ষামন্ত্রী। মের্কেল ক্যাবিনেটে নতুন মুখ, শিক্ষার সাথেও সরাসরি যোগাযোগ নেই তাঁর, তবুও শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। মের্কেল এর গত তিন দফায় মোট ১২ বছরের সরকার পরিচালনায় ইনি হলেন চতুর্থ শিক্ষামন্ত্রী, ওয়েস্টফালিয়া অঞ্চলে পারিবারিক হোটেল ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত একজন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ এখন জার্মানির শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছেন গত একমাস থেকে।
সম্পুর্ন অপরিচিত এই নারী রাজনীতিবিদ শিক্ষা অঙ্গনে বড় পরিবর্তন আনতে চান।
জার্মান বাৎসরিক ব্যয় ৩২৯ বিলিয়ন ইউরো বাজেটের ১৮ বিলিয়ন শিক্ষাখাতে ব্যয় হয়, অর্থাৎ সমগ্র বাজেটের প্রায় ৬% খরচা হয় শিক্ষায়, এছাড়াও প্রাইভেট সেক্টর থেকে গবেষণার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসে আরো ৬ বিলিয়ন, এই মিলিয়ে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ইউরো শিক্ষাখাতে ব্যয়। তবুও নতুন শিক্ষামন্ত্রী কার্লিচেক দাবি করলেন তাঁর দরকার আরো এক বিলিয়ন, যা দিয়ে শিক্ষাকে আরো সেবামুলক ও জনপ্রিয় করে তুলতে চান তিনি। এখানে শিক্ষার নামে নেই কোনো কোচিং বাণিজ্য, নেই কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যবসা। বিনা বেতনে প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকলেরই অধিকার লেখাপড়া শেখার, উল্লেখযোগ্য যে জার্মানিতে সকল মানুষের এমনকি বিদেশী ছাত্রদের শিক্ষাও বিনা খরচায় সকলের জন্য উন্মুক্ত।
৮০ মিলিয়ন মানুষের বসবাস এই দেশটি বাংলাদেশের প্রায় ৪ গুন বড়, ৪২৮ টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে প্রায় ৩ মিলিয়ন ছাত্রছাত্রী যার ২৫% বিদেশি লেখাপড়া করে প্রায় বিনা খরচায়। জার্মানির শিক্ষার মান সারা পৃথিবীতেই বেশ কদর রয়েছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য জার্মানিকে স্বর্গ বলা চলে। বিশ্ববিখ্যাত অনেক রিসার্চ। ইনস্টিটিউটের জন্ম জার্মানিতেই। এ পর্যন্ত ১০৭ টি নোবেল জার্মানদের কাছে গেছে যা বিশ্বে তৃতীয়। এ ছাড়া জার্মানির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো এখানে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি নেই। অর্থাৎ আপনি ফ্রিতে পড়তে পারবেন। এখানে সামাজিক নিরাপত্ত অনেক বেশি অর্থনৈতিকভাবেও জার্মানি বেশ শক্তিশালী। ইউরোপের প্রথম ও বিশ্বের চতুর্থ পরাশক্তি হলো বর্তমানে এঙ্গেলা ম্যার্কেলের নেতৃত্বাধীন দেশটি। তাই পড়াশোনা শেষে স্থায়ী চাকরি অথবা বসবাসের জন্য এই দেশটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ।
সবশেষে একটি তুলনামুলক আলোচনা করতেই হয়, যে মুহুর্তে আজ ইউরোপের এই দেশটির শিক্ষার মান নিয়ে কথা বলছি ঠিক সেই মুহুর্তে খবর আসে বাংলাদেশে ৫৬০ টি ইসলামি সেন্টার নির্মানের জন্য সরকার প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার পরিকল্পনা করে ফেলেছে। স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ না করে, অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু না করে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় ইন্সটিটিউশন তৈরি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয় কি? কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫৬০ টি ইসলামি সেন্টারের প্রথম দফায় ৯টি উদ্বোধন করতে গিয়ে বললেন "ধর্মের প্রচার ও প্রসার হোক এবং দেশে ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা হোক।" এই কথার মাধ্যমে তিনি আর একবার সংবিধান লঙ্ঘন করলেন, কারণ সংবিধানে কোথাও লেখা নেই যে রাষ্ট্রীয় ভাবে রাষ্ট্রের অর্থে ইসলামী ইন্সটিটিউশন তৈরি করতে হবে।
আঙ্গেলা মের্কেল এর সরকার কিন্তু ধর্মীয় ইন্সটিটিউশন তৈরি করণে একটি পয়সাও দেয় না, কারণ ধর্ম চর্চাক্ষেত্র রাষ্ট্র থেকে আলদা হয়েছে ফরাসি বিপ্লব এর পর থেকেই। সম্পূরক আর একটি তথ্য দিয়ে শেষ করি, আঙ্গেলা মের্কেল এর ক্যাবিনেটে মাত্র ১৫ জন মন্ত্রী যার মধ্যে ৭ জন নারী, আর হাসিনা ক্যাবিনেটে ৬৫ জন মন্ত্রী তার মধ্যে মাত্র ৩ জন নারী।