মোনাজ হক

সম্পাদক আজকের বাংলা ডট কম

৫ ফেব্রুয়ারি কে ভুলে গেলে চলবে না

মনে আছে নিশ্চয়ই আমাদের সকলেরই ৫ বছর আগের কাহিনী, ২০১৩ সনের শাহবাগ আন্দোলনের কথা। আজ ৫ ফেব্রুয়ারী এই দিনে শাহবাগ চত্বরে একত্র হয় কয়েকজন ব্লগার। শুরু হয় তাদের গণদাবি থেকে শাহবাগ আন্দোলন, তারপর গন জাগরণ। কেনো শুরু হয়েছিলো তাও আমরা ভুলি নি। সেক্টর কমান্ডার ফোরাম ও নির্মুল কমিতির চাপে আওয়ামীলীগ সরকার যুদ্ধ অপরাধির বিচার ট্রাইবুনাল গঠন করতে বাধ্য হয়।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দ্বিতীয় রায় হয়েছে (প্রথম আসামি পলাতক থাকায়), এই রায় একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের চেয়ে কম লজ্জার নয়। তিন-চার’শ মানুষ হত্যা আর শতাধিক ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণিত হবার পর জামায়াতি নেতা কাদের মোল্লাকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। লাখো শহীদের রক্ত এতোই সস্তা! মূল্যহীন! হাজারো নারীদের সম্ভ্রমের কোনো মূল্য নেই? এতোই নগণ্য মা-বোনের সম্মান!

শাহবাগে দশজন থেকে এক’শজন, তারপর হাজার পেরিয়ে লাখো মানুষের সমাগম কোনো দলের ইস্যুকে কেন্দ্র করে নয়। এটা গনমানুষের দাবি, ৪২ বছর পরে যুদ্ধাপরাধী বিচার কোনমতে পার করে দেবার জন্যে নয়, ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ঠিক রাখার দায়িত্ব সকলের সাথে নতুন প্রজন্মেরও। তাইতো লাখো কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো "রাজাকারের ফাঁসি চাই"

রক্তের রং লাল হয়, রক্তের ঋণও লাল, রক্তের মতোই পবিত্র। কিন্তু আমাদের ঢাক-ঢোল পেটানো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নিশ্চয়ই শহীদদের রক্তের রঙকে চিনতে পারে নি, আর তাই কাদের মোল্লাকে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে কয়েক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে দায়িত্ব এড়াতে ছেয়েছিলো।

এই দায়িত্ব এড়ানোর অভিযোগটি এইজন্যই আসে কারণ, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হবে বলে অঙ্গীকার ছিলো। সংসদের প্রথম অধিবেশনে এ ব্যাপারে সর্বসম্মতিক্রমে একটি আইনও পাস হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় দীর্ঘ দু'বছর পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। প্রথমে সরকার ট্রাইবুনালের জন্য কাওরানবাজারে একটি পুরানো ভবন বরাদ্দ করে, তাতে প্রচন্ড প্রতিবাদ হয় এবং শেষে পুরানো হাইকোর্ট ভবনে স্থানান্তর হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আবদুল মতিনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু যখন জানা গেলো, আবদুল মতিন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন এবং বরিশালের বিএম কলেজে তিনি বর্তমান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছেন, তখন বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ উঠলো এবং তিনি পদত্যাগ করলেন। এই প্রেক্ষাপটে তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠিত হয় ২০১১ সালে, এসব ঘটনা থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, আওয়ামীলীগ হয়তো যেনতেন ভাবে এই দীর্ঘদিনের দাবি যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করতে চেয়েছিলো।

৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের রায় ঘোষণার পর তা প্রত্যাখ্যান করে শাহবাগে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। দিনে দিনে সেখানে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি এবং জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছে ছাত্র-জনতা।

কয়েক দিনের মধ্যেই শক্তিশালী হয়ে উঠছিলো শাহাবাগ সমাবেশ। কেউ চিন্তাই করে নি যে, গুটিকয়েক ব্লগারের চিন্তার ফসল এভাবে গনআন্দোলনে রূপ নেবে। প্রতিদিনই একটু একটু করে বিশাল একটি শক্তিতে পরিনত হচ্ছে। সবচাইতে বড় বিষয়টি হচ্ছে, এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের কোনো প্রয়োজন হয় নি এতোবড় একটি সমাবেশ ঘটানোর জন্য, যেখানে মায়ের কোলের শিশু থেকে আশীতিপর বৃদ্ধও একত্রিত হয়েছিলো। ফুঁসে ওঠা রাগ আর প্রতিবাদ, হয়তো সেটাই কাল হয়ে দাঁরিয়েছিলো। না হলে যারা এতবড় একটা ঝাঁকুনি দিলো তাদেরি নামের লিস্ট করে মৌলবাদীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে দিয়ে তাদেরই একাংশকে একের পর এক হত্যা করলো, সেই রাজাকারদের দোসরদের চাপাতির আঘাতে, আর বাঁকি ব্লগাররা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো। যারা প্রাণ দিলো চাপাতির আঘাতে তাদের খুনিদের আজো বিচার হয় নি। গত ৫ বছরে সরকার হলো তাদেরি হাতে জিম্মি, সেই মৌলবাদী শক্তিই এখন ক্ষমতাসীনদের সাথে একত্র হয়ে, প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে ইসলামীকরণ করে নিয়ন্ত্রণ করে।

তাই ৫ ফেব্রুয়ারি কে ভুলে গেলে চলবে না, কি পেয়েছি আর কি পাই নি তার হিসেব মেলাবার দিন আজকে। ঝাঁকুনি দিতে হবে আবার, একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয় নি এখনো।

2131 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।